বেপরোয়া খুচরা চাল বিক্রেতারা!

প্রশাসনের এক গুঁতোয় পাইকারি বাজারে কমেছে চালের দাম। শুরুতে বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা কমলেও বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০০-৩৫০ টাকায়। যা কেজি প্রতি ৬-৭ টাকা কম। কিন্তু খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি এখনো পর্যন্ত শুরুর দিকের ১-২ টাকা কমেই বিক্রী হচ্ছে চাল। দাম কমাতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন খুচরা বিক্রেতাদের অভিযানের সতর্কতা দিলেও কে শুনছেন কার কথা। বরং বেপরোয়াই মনে হচ্ছে খুচরা চাল বিক্রেতাদের।

এমনভাব পরিলক্ষিত হয়েছে চাল ব্যবসায়ী সমিতির নামে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট নেতাদের আলাপে। তাদের এক কথা- বেশি দামে কেনা চাল বিক্রী শেষ না হওয়া পর্যন্ত খুচরা পর্যায়ে চালের দাম কমানো সম্ভব নয়। কম দামের নতুন চাল আনলে খুচরা বাজারেও চালের দাম কমবে।

নগর চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনামুল হক এনাম এই অভিমত ব্যক্ত করেন। একই কথা বলেন-নগরীর বহদ্দারহাট খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম ও চকবাজার খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. ফরিদও।

দাম কমানোর বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সতর্কতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চকবাজার খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. ফরিদ বলেন, বেশি দামে চাল কেনার সময় তো প্রশাসন কিছুই বলেনি। বরং চালের দাম বাড়ার পেছনে দায়ী এই প্রশাসন ও সরকারের বর্ধিত শুল্কহার। তাহলে কোন দামে চাল বিক্রী করব তা প্রশাসন বললেই হলো।

বেশি দামে চাল বিক্রীর কথা তো পাইকারী ব্যবসায়ীরাও বলছেন, কিন্তু অভিযানের মুখে তারা মজুদ ছেড়েছেন। আপনারা ছাড়ছেন না কেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা ছেড়েছে। আমরা ছাড়ব না। প্রয়োজনে চাল বিক্রী বন্ধ করে দেব, তবুও লোকসান দেব না।

প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের পাইকারী ব্যবসায়ীদের গুঁতিয়েছে। খুচরা বিক্রেতাদের গুতালে বেশি দামে কিনে খাওয়ার জন্যও চাল পাবে না। সে কারণে তো খুচরা পর্যায়ে দাম কমাতে বললেও এখনো পর্যন্ত অভিযানে নামেনি প্রশাসন।

সরজমিনে কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অভিযানের পর মিয়ানমার থেকে আমদানি করা চাল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩০০ টাকা কমে গতকাল (২৯ সেপ্টেম্বর) শুক্রবার সকালে ১৫৫০ টাকায়, ভারত থেকে আমদানি করা বেতি চাল ৩০০ টাকা কমে ১৭৫০ টাকায়, ভারতীয় সেদ্ধ চাল ৩৫০ টাকা কমে ২০৫০ টাকায়, থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা চাল ৩০০ টাকা কমে ২০৫০ টাকায় বিক্রী হচ্ছে। যা বুধবার পর্যন্ত যথাক্রমে ১৬৫০, ১৮৫০, ২১৫০ ও ২১০০ টাকায় বিক্রয় হয়েছিল।

সেই হিসাবে বৃহস্পতিবার থেকে পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি ৬-৭ টাকা কমেছে চালের মূল্য। এর আগে প্রথম দফায় ৪-৫ টাকা কমে গত বুধবার পর্যন্ত চাল বিক্রী হয়েছিল। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রথম দফায় ১-২ টাকা কম মূল্যে এখনো বিক্রী হচ্ছে চাল। দ্বিতীয় দফায় চালের মূল্য আরও ১-২ টাকা কমলেও তার কোনো প্রভাব নেই। দেশি চালের মূল্যও বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা কমার পর আর কমেনি। এরমধ্যে জিরাশাইল ৩১০০ থেকে ৩০০০ টাকা, মিনিকেট সেদ্ধ ২৭০০ থেকে ২৬০০ টাকা, আশুগঞ্জ বেতি ২৬০০ থেকে ২৫০০ টাকা দরে বিক্রয় হলেও খুচরা বাজারে কমেনি এক টাকাও।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন (ক্যাব) এর চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি নাসরিন সুলতানা বলেন, হাওড়ে বন্যার পর চালের মূল্য বেড়ে যায়। এরপর সরকার শুল্কহার শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনলেও চালের দাম কমেনি। অথচ শুল্কহার কমানোর সুযোগে আমদানিকারকরা লাখ লাখ টন চাল আমদানি করে মজুদ গড়ে তোলে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অনৈতিক। ফলে সরকার অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে অভিযান শুরু করে। অভিযানে চট্টগ্রামে মজুদ ৮০ হাজার বস্তা চাল জব্দ, অবৈধ মজুদ গড়ে তোলায় সংশ্লিষ্টদের আটক ও অর্থ জরিমানা করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত। ফলে বাধ্য হয়ে চালের মজুদ ছেড়ে দেওয়ায় পাইকারী পর্যায়ে কমেছে চালের দাম।

তিনি বলেন, পাইকারি পর্যায়ে কমলে খুচরা পর্যায়েও দাম কমবে এটাই তো নিয়ম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে-পাইকারীর মতো খুচরা ব্যবসায়ীরাও চালের মজুদ গড়ে তুলেছে। যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চালের মূল্য কমানো সম্ভব নয় বলে গণমাধ্যমে বলছেন ব্যবসায়ীরা। এখন দেখছি খুচরা পর্যায়েও চালের মজুদের বিরুদ্ধে অভিযান জরুরি হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম চাক্তাইয়ের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম এ প্রসঙ্গে বলেন, ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে চট্টগ্রামের মজুদদাররা চাল ছেড়ে দিলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা এখন চাল নিচ্ছে না। মজুদ ধরে রাখায় খুব কম চাল কিনছে খুচরা বিক্রেতারা। অথচ প্রশাসন শুধু পাইকারি ব্যবসায়ীদের তাড়া করছে। চাল জব্দ করছে, জেল-জরিমানা করছে। ফলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বেকায়দায়। প্রশাসন থেকে চাল রক্ষায় গুদাম থেকে চাল গোপনে সরিয়ে রাখতেও হিমশিম খাচ্ছে পাইকারী ব্যবসায়ীরা।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোরাদ আলী বলেন, খুচরা বাজারে চালের মূল্য কমানোর বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সতর্কতা রয়েছে। কিন্তু কোনো সতর্কতায় কান দিচ্ছেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা। ফলে কম সময়ে খুচরা বাজারেও অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রশাসন।

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট যত শক্তিশালীই হোক না কেন? আইন ও নৈতিকতার কাছে কিছুই না। সিন্ডিকেটের প্রভাব পাইকারী ব্যবসায়ীরাও খাটিয়েছেন। তাতে কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হয় কি। রাষ্ট্রের স্বার্থে সরকার যে কোন পদক্ষেপ নিতে পিছ পা হবে না বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ২৯ সেপ্টেম্বর  ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস