বাংলাদেশের নামে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি করছে অন্য দেশ

জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের নামে ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানির অভিযোগ উঠেছে এশিয়ার একাধিক দেশের বিরুদ্ধে। সমপ্রতি বাংলাদেশের দুটি কোম্পানির নামে রপ্তানি হওয়া ১১ হাজার বাইসাইকেলের ৫টি চালান আটক করা হয়। আটক করা ওইসব চালান জার্মানি হয়ে পোল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এশিয়ারই দেশ চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলঙ্কা থেকে এসব চালান রপ্তানি করা হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নামে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে পণ্য রপ্তানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বছরও বাংলাদেশের নামে ইউরোপে রপ্তানিকালে ২৩৬টি চালানে সন্দেহ তৈরি হলে তা আটক করা হয়। পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ৩৩২টিই ভুয়া সনদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা চালানের মাত্র চারটি প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু হওয়া জিএসপি সনদ বেহাত হওয়ার মাধ্যমে তা অন্য দেশের রপ্তানির হাতিয়ার হয়ে থাকতে পারে। এমন জালিয়াতির সঙ্গে কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকতার পাশাপাশি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে অভিযোগ রয়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে ইউরোপ জিএসপি’র ক্ষেত্রে নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপের ২৮টি দেশে জিএসপির আওতায় অস্ত্র বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এ জন্য সরকারি সংস্থা হিসেবে ইপিবি সনদ ইস্যু করে থাকে। এটি জিএসপি সনদ নামে পরিচিতি। বাংলাদেশ ছাড়া চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার বাংলাদেশের প্রতিযোগী বেশিরভাগ দেশই এ সুবিধা পায় না। ফলে উচ্চহারের শুল্ক পরিশোধ করে তাদের ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করতে হয়। ইপিবি সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপের বাজারে চীনের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার কমপক্ষে ১২ শতাংশ। মূলত উচ্চ হারের শুল্ক এড়াতে এ জালিয়াতি করা হয়ে থাকে।

আটক করা চালানগুলোর বিপরীতে ইস্যু করা জিএসপি সনদের সত্যতা যাচাই করছে ইউরোপীয় কমিশনের দুর্নীতি দমন অফিস-ওলাফ। ইস্যুটির সত্যতা যাচাই করতে ইউরোপীয় কমিশন থেকে ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসকে চিঠি দিয়েছে ওলাফ। অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্ত করেছে ইপিবি। ইপিবি’র একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বাইসাইকেলের ওইসব পণ্য চালান বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ইপিবি’র নামে ইস্যু করা ওইসব জিএসপি সনদও ভুয়া। এ জালিয়াতির ইস্যুটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে আগামী অক্টোবরে ঢাকায় আসবে ওলাফের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। ইউরোপে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে তাদের দেওয়া শর্ত যথাযথভাবে পূরণ হয় কিনা তা খতিয়ে দেখবেন তারা। জিএসপি সুবিধা পেতে বাংলাদেশ রুলস অব অরিজিন বা স্থানীয়ভাবে মূল্য সংযোজনের শর্ত মানছে কিনা তা যাচাই করা হবে। রুলস অব অরিজিনের শর্ত অনুযায়ী জিএসপি পেতে হলে অন্তত ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর (বিন) ব্যবহার করে এ অপকর্ম করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মিল থাকলেও বিন নম্বর ভুয়া। আবার নাম ঠিকানা ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু যে সনদ ব্যবহার করে এ রপ্তানি করা হয়েছে, তা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেয়া।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের নামে অন্য দেশ পণ্য রপ্তানি করে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে আর্থিক বিবেচনায় কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এসব কারনে শুল্কমুক্ত রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন শর্ত আরোপ করতে পারে। নতুন নিয়ম ও প্রক্রিয়াগত জটিলতাও তৈরি হতে পারে। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ব্যবসায়ের খরচ ও সময় বাড়বে। তিনি মনে করেন, জিএসপি সনদ জালিয়াতির পেছনে একটি চক্র জড়িত। আর জিএসপি সনদ বিতরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিদ্যমান ত্রুটির সুবিধা নিচ্ছে এ চক্র। ইস্যুটিকে গুরুত্বেও সঙ্গে দেখা দরকার। ইপিবিসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে। সূত্র- ইত্তেফাক।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ০৭ সেপ্টেম্বর  ২০১৭

Scroll to Top