দাঁড়াতে পারছেন না স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তারা

সারা দেশের এক কোটির বেশি ছোটবড় শিল্পোদ্যোক্তার পাশে যেন কেউ নেই। নিজেরাই সংগ্রাম করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। একদিকে অর্থনৈতিক নানা সংকট অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকঋণ ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নানা জটিলতা, নতুন চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের শিল্প খাত ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির চাপে কারখানা বন্ধ করতে হচ্ছে, বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে অযাচিত শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধে পুলিশি সহায়তা চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেক উদ্যোক্তা অভিযোগ করছেন। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে যারা কাজ করছে, সেসব বড় কোম্পানি ব্যবসা সম্প্রসারণের চেয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি একেবারেই থমকে গেছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া, উচ্চ সুদহার, ডলার বাজারে নৈরাজ্য, চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা, গ্যাস সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কমে যাওয়াসহ বহুমুখী সংকটে বেসরকারি খাত এখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।

কয়েক দিন পরপর শ্রমিক অসন্তোষ ঘিরে পুরো শিল্প খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। নানামুখী চাপে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ব্যবসায় সংকোচন করতে বাধ্য হচ্ছেন। গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, অবকাঠামোর অনুপস্থিতি, ডলার ঘাটতির মধ্যে মূল্যস্ফীতির বড় চাপ সামলাতে হচ্ছে তাঁদের। ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার উদ্যোক্তাদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে না পারায় স্থবির হতে বসেছে অনেক শিল্প। ডলার সংকটের সঙ্গে ব্যাংকের তারল্য সংকটে ঋণ না পাওয়ায় দেশের অনেক উদ্যোক্তাই এখন কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে মনে করছেন বিদেশি ষড়যন্ত্রে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের চাপে ফেলা হচ্ছে।

২০২০ সালে কভিড পরিস্থিতির কারণে সারা দেশে ব্যবসায়ীদের ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কভিড পরিস্থিতির উন্নতির পরে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। যার প্রভাবে ডলার সংকট তৈরি হয় সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালে সরকার ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে ৯/৬ নীতি চালুর করে। ওই নীতির পর উদ্যোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি এলেও বৈশ্বিক সমস্যার কারণে জ্বালানি সংকট, ডলার সংকট, দেশে মূল্যস্ফীতি শিল্প খাতে নেতিবাচক পড়ে। গত বছরের শেষ দিকে দেশের ডলার সংকট এত বেশি ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ৮৫-৮৬ টাকার ডলার ১২৫-২৬ টাকায় পৌঁছায়।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। সর্বশেষ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। খাদ্যে এই মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ। এই সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে বেড়ে গেছে আমদানি খরচ। আবার ডলার সংকটের কারণে আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। একদিকে দেশের বাজারে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম হু-হু করে বেড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে কেনাকাটায় কাটছাঁট করছে সাধারণ মানুষ। শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট সব পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। গত তিন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ২৫ শতাংশের বেশি। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তির হার ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে। শিল্প কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েছে কিন্তু এখনো যথেষ্ট আস্থা তৈরি করতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা এখনো নিরাপদ নন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক কারখানায় হামলা হয়েছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল দীর্ঘদিন। তারা এখনো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেনি। এটা আমাদের বড় সংকট। তিনি বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ব্যাংকঋণের সুদের হারও বাড়িয়ে দিয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ পরিশোধ করা কঠিন করে তুলেছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণও এটি। সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি এই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। ব্যবসায়ীরা যদি ভালো না থাকে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে না, অর্থনীতি দাঁড়াতে পারবে না।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, আইএমএফ থেকে বলা হয়েছে আমাদের সামনের দিনগুলো অত্যন্ত অনিশ্চিত এবং অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতার ঝুঁকি প্রকট। মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বন্যা এবং কঠোর মদ্রানীতির কারণে এই আশঙ্কা তারা করছে। কয়েক মাস ধরে বেশির ভাগ ব্যবসায় আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা সমস্যা, জ্বালানি সংকট এবং কঠোর ব্যাংকিং তারল্যের কারণে উৎপাদন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক থেকে কার্যকরী মূলধনের জোগানের কড়াকড়ির কারণে এটি আরও বেড়েছে। এই সময়টাতে মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেশ শক্তিশালী ছিল। দেশের উদ্যোক্তারা যদি ভালো না থাকে, অর্থনীতি কোনোভাবে ভালো থাকবে না। দেশের মানুষ ভালো থাকবে না। উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

Scroll to Top