প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের অভিযোগ রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। জমির মালিকদের ঠকানো ছাড়াও কমিশন বাণিজ্যসহ এক্ষেত্রে নানা উপায়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয় শত শত কোটি টাকার। এসবের কারণে বেড়ে গেছে প্রকল্প ব্যয়, যার ভার চেপেছে সাধারণ মানুষের কাঁধে।
বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম বিতর্ক জাগানিয়া প্রকল্প চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ গড়ায় সংঘর্ষে; ঘটে প্রাণহানিও। পরবর্তীতে জমির মালিকদের পাওনা পরিশোধে অনিয়মও হয়েছে খবরের শিরোনাম।
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঢাল করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এস আলমের বিরুদ্ধে। প্রকল্পটির নাম করে বাঁশখালীর গড্ডামারায় ৬৬০ একর জমি দখলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ভরাট করা হয় উপকূল ও সমুদ্রতটের জায়গা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ছাড়াও সেখানে আরও কিছু প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিলো এস আলমের।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে এস আলমের দখলে গেছে প্রয়োজনের তুলনায় ৩৫৭ একর বেশি জমি। একই সঙ্গে জমি কেনা এবং অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয় ২৫৫ কোটি টাকার।
একই রকম অভিযোগ রয়েছে আরেক বিতর্কিত প্রকল্প বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেলায়ও। এটির নামে বরিশাল ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানির বিরুদ্ধে ২৩০ একর অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের তথ্য উঠে আসে টিআইবির গবেষণায়। আর জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় ১৫ কোটি টাকার।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বি. ডি রহমতউল্লাহ বলেন,
জমি দখলের একটি সংস্কৃতি আমরা দেখেছি বিগত সরকারের আমলে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে ১০ গুণ বেশি জমি দখল করে অনেকেই সেখানে অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কারণ বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে জমি নেয়ায় সেই জমি অধিগ্রহণ বৈধ হয়ে গেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত সরকারের আমলে প্রশাসনের সহায়তায় যতটুকু দরকার তার চেয়ে বহুগুণ বেশি জমি জোরপূর্বক জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মতো প্রশ্ন রয়েছে, সরকারি উদ্যোগে নির্মিত প্ল্যান্ট নিয়েও। অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় মাতারবাড়ির ব্যয় ধরা হয় দ্বিগুণ। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি, ৫১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ২০ হাজার কোটি টাকাই ব্যয় হয় গভীর সমুদ্র বন্দরের পেছনে।
তবে তারপরও এখানে রয়েছে নানা অসঙ্গতি-অনিয়মের অভিযোগ। লবণ চাষিদের ঠকিয়ে এক হাজার ৬০৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরও কিছু প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেসব আর আলোর মুখ দেখেনি। বরং যাবতীয় ব্যয়ের ভার চাপানো হয় মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর।
এমন সব বাড়তি ব্যয়ের বোঝা স্বাভাবিকভাবেই পড়ছে সাধারণ মানুষের কাঁধে। কারণ প্রকল্পের অর্থায়ন আর বিদ্যুতের মূল্য যে চুকাতে হয় গ্রাহকদেরই। প্রকৌশলী বি. ডি রহমতউল্লাহ বলেন, সরকারকে ব্যবহার করে বড় শিল্পগোষ্ঠীরা প্রথমে জমি দখল করে রেখে দেয়। পরে অর্ধেক জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তবে যাদের থেকে জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তারা জমি হারা হয়ে যায়।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করে সম্পদ বিকাশের জন্যই অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। আর ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে সাধারণ মানুষের কাঁধে।
পরিবেশগত ঝুঁকি থাকার পরও বিদ্যুতের কয়লানির্ভর পরিকল্পনার পেছনে ছিল সাশ্রয়ী উৎপাদন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পিডিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ গুনতে হয়েছে ১৪ থেকে ১৯ টাকা পর্যন্ত।