২০ গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে রিজার্ভের প্রায় ৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা বেলাল আহমেদের মালিকানাধীন ইউনিটেক্স স্টিলের কাছে আটকা ১ কোটি ১২ লাখ ডলার।
সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও পদত্যাগ করেছেন। এর আগে চার ডেপুটি গভর্নর, উপদেষ্টা ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধানকে পদত্যাগে বাধ্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে পুরো ব্যাংক খাত অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। বিশেষ করে জোর করে মালিকানা পরিবর্তন করা ব্যাংকগুলোতে শুরু হয়েছে মালিকানা ফিরে পাওয়ার আন্দোলন। অনেক দিন ধরেই ব্যাংকসহ দেশের আর্থিক খাত নাজুক পরিস্থিতি চলছে।
খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ‘নখদন্তহীন’ অবস্থায় রয়েছে। জোর করে মালিকানা দখল করা ব্যাংকগুলো খালি করে ফেলেছেন নতুন মালিকেরা। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো জামানত ছাড়া ছাপানো টাকা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে ছয়-সাতটি ব্যাংক। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত থেকে ডলারে ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। নথিপত্রে দেশে এখন খেলাপি ঋণ দুই লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবে তা প্রায় চার লাখ কোটি টাকা বলে মনে করা হয়। বেনামি ঋণ, প্রকৃত তথ্য গোপন ও কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে খাতটির প্রকৃত তথ্য অজানা রয়ে গেছে। ফলে ব্যাংক খাতের প্রকৃত তথ্য বের করে আনাই অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় দেশে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। তবে পুনঃতফসিল করা ঋণ, আদালতের আদেশে স্থগিত করা ঋণ মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০০৯ সালের পর ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ প্রায় ১৫টি নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে বহুল আলোচিত পদ্মা ব্যাংক প্রায় ‘দেউলিয়া’ হয়ে এখন একীভূত হওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। এদিকে গত ৮ বছরে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডসহ (এসআইবিএল) কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে। সেই সুবাদে দেশের ছয়টি ব্যাংক এখন চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এসব ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় দুই বছর ধরে টাকা ধার নিয়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম কোনোমতে টিকিয়ে রাখছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো মালিকেরা টাকা বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সরকার পরিবর্তনের পর বেনামি ঋণের মাধ্যমে অর্থ তুলে নেওয়ার প্রবণতা ঠেকানোর পদক্ষেপ নিয়েছে বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক। গত মঙ্গলবার ব্যাংকটি ৮৮৯ কোটি টাকা উত্তোলন ঠেকিয়েছে। এসব অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল গ্লোডেন স্টার ও টপ টেন ট্রেডিং হাউস নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। কর্মকর্তারা জানান, দুটি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংকের মালিকপক্ষের সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকাররা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের ফলেই তাঁরা এভাবে অর্থ তুলে নেওয়া ঠেকাতে পেরেছেন।
কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকায় টিকে আছে, আবার রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়েও অনেকে ফেরত দিচ্ছেন না। এটাই ব্যাংক খাতের প্রকৃত পরিস্থিতি। আসলেই অবস্থা আরও খারাপ কি না, সেটা বের করা জরুরি।
মুস্তফা কে মুজেরী, সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক
আলাদা আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন ব্যাংক ও তাঁদের ঋণের হিসাব দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির বাইরে আছে। ফলে বড় গ্রাহকেরা নামে-বেনামে কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, তা অজানা রয়ে গেছে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন চাইলেও ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আগে তদারকি করে প্রকৃত তথ্য বের করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের বিরুদ্ধে ওই সব বড় খেলাপি গ্রাহকের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখার অভিযোগ ছিল। এসব উদ্যোক্তার মধ্যে অনেকেরই যাতায়াত ছিল গভর্নরের ঢাকার গুলশানের বাসভবন ‘গভর্নর হাউস’-এ। নিজের সন্তানের বিয়ের অনুষ্ঠানে খেলাপি গ্রাহক এবং ব্যাংক থেকে গাড়ি ও স্বর্ণালংকার নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে একজন ডেপুটি গভর্নরের বিরুদ্ধে। এর নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের মাধ্যমে ডলার ধার দিয়েছে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের। এসব ডলারের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নথিতে দেখা গেছে, ২০ গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে প্রায় ৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইউনিটেক্স স্টিলের কাছে আটকা ১ কোটি ১২ লাখ ডলার। প্রতিষ্ঠানটির মালিক বেলাল আহমেদ হলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা। খেলাপিতে এরপরই ফয়েজউদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানির অবস্থান, তারা ৬৬ লাখ ডলার খেলাপি। বিএসআরএম স্টিল ৫৮ লাখ, সিটি সীড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ ৪৪ লাখ, নাসির গ্লাস ৪০ লাখ, বাংলাদেশ চায়না রিনিউএবল এনার্জি ৩৫ লাখ, নাজমা পেপার ৩০ লাখ, নাসির কোয়ালিটি গ্লাস ২৯ লাখ, এনএস করপোরেশন ২৮ লাখ, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন ২৭ লাখ, ডিসকোভারি ট্রেডিং ২৫ লাখ ডলার খেলাপি। ৩৫ লাখ ডলার খেলাপি হয়েছে ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি-২৩।
এফ-জেড টেকনোলজি ও সান্তানা এন্টারপ্রাইজ ২৩ লাখ ডলার করে; ইউকে-বাংলা সিমেন্ট ২১ লাখ, আনলিমা মেঘনাঘাট ২০ লাখ, ট্রেড ব্রিজ ১৯ লাখ, খুলনা প্রিন্টিং ১৮ লাখ ও এমইবি ইন্ডাস্ট্রিজের ১৮ লাখ ডলার খেলাপি। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো ফার্মার কাছে আটকা প্রায় ২০ লাখ ডলার।
জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত গত জুলাইয়ের শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫৯২ কোটি ডলার। এর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের দেওয়া আছে ২৬০ কোটি ডলার, যা বড় অংশই আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে আছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকায় টিকে আছে, আবার রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়েও অনেকে ফেরত দিচ্ছে না। এটাই ব্যাংক খাতের প্রকৃত পরিস্থিতি। আসলেই অবস্থা আরও খারাপ কি না, সেটা বের করা জরুরি। এ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। এরপর অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার। ব্যাংক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যেটা করা দরকার, তা এখনই শুরু করতে হবে। না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে।