শ্রম আইন দ্রুত সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশকে ১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়ে দিয়েছে দেশটি।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত ফোরাম টিকফার বৈঠকে দফাগুলো তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দেশটির বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআর-এর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি ব্রেন্ডেন লিঞ্চ নেতৃত্ব দেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন তপন কান্তি ঘোষ।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে ১১ দফা সুপারিশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- (১) ট্রেড ইউনিয়নে জড়িত শ্রমিক, সংগঠক, প্রতিবাদকারী এবং আইনি ও তদন্ত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং নির্যাতনে জড়িত মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ বাড়াতে হবে; শ্রম-সংক্রান্ত কার্যক্রমকে অপরাধ বা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে গণ্য করা যাবে না; (২) শ্রম-সংক্রান্ত ইস্যুতে যেসব শ্রমিকের বিরুদ্ধে অনৈতিক শ্রমচর্চার অভিযোগ তুলে মালিকপক্ষ, কোম্পানি ব্যবস্থাপনা এবং ব্যক্তিপর্যায়ে মামলা হয়েছে সেসব মামলায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে; মামলার তদন্ত কার্যক্রমে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে; অনৈতিক শ্রমচর্চার বিষয়টি আইনে সুনির্দিষ্ট ধারায় সংজ্ঞায়িত করতে হবে; (৩) আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার সুপারিশ ও শ্রম খাতের আন্তর্জাতিক আইনগুলোর মান অনুসরণ করে শ্রম আইন সংস্কার করতে হবে; এ ক্ষেত্রে (ক) ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে কমপক্ষে ২০ জন শ্রমিকের সম্মতি বা স্বাক্ষর গ্রহণের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে; ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের পর স্বাক্ষরকারী বা সম্মতি দেওয়া শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেলেও নিবন্ধন বাতিল করা যাবে না; (খ) নিবন্ধনকালে শ্রমিকের আইডি নম্বর, জন্মনিবন্ধন নম্বর বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরের বেশি ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া যাবে না; (গ) ট্রেড ইউনিয়নের দুটি সাধারণ সভায় সব শ্রমিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়টি নিবন্ধনের শর্ত থেকে বাদ দিতে হবে; যারা শ্রম খাত ও ট্রেড ইউনিয়ন ইস্যুতে বৈষম্য করবে কিংবা অনৈতিক শ্রমচর্চা করবে, আইনে তাদের জরিমানা বাড়াতে হবে; (ঘ) শ্রমিকের ধর্মঘট ডাকার বিষয়ে আইনের যেসব ধারায় অতিরিক্ত কঠোরতা দেখানো হয়েছে, তা বাদ দিতে হবে; (৪) শ্রম আইনের প্রেক্ষাপটে শ্রমনীতি সংশোধন করতে হবে; (৫) রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)-এ কর্মরত শ্রমিকদের সংগঠন ও দরকষাকষি করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে; (৬) বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে শ্রমিকদের দরকষাকষির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে; (৭) ট্রেড ইউনিয়নের আবেদনের প্রশাসনিক কার্যাদেশ ৫৫ দিনের মধ্যে আইনি কার্যাদেশে পরিণত হবে; (৮) ট্রেড ইউনিয়নের জন্য অপেক্ষমান আবেদনগুলো শ্রম অধিফতরের অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে; (৯) শ্রমিকের স্বাক্ষর-সংক্রান্ত ইস্যুতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে শ্রম অধিদফতর অযথা বিলম্ব করতে পারবে না; এ ক্ষেত্রে সব ধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে; (১০) আইএলওর পরামর্শ মেনে শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা, পদের সংখ্যা এবং এ খাতে বাজেট বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে; এবং (১১) যেসব কারখানা শ্রম খাতের কমপ্লায়েন্স (অগ্নি ও ভবনের নিরাপত্তাসহ) নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির বিধান বাড়াতে হবে। তপন কান্তি ঘোষ বলেন, তারা ১১ দফা সুপারিশ করে শ্রম আইন দ্রুত সংস্কারের তাগিদ দিয়েছেন। আমরা বলেছি, শ্রম আইন সংস্কারের বিষয়টি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। এখানে মালিকপক্ষ ছাড়াও সরকার ও শ্রমিকপক্ষ রয়েছে। এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত নিয়েই শ্রম আইনের সংস্কার হবে। এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়।
টিকফা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধার যৌক্তিকতাও তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান বাণিজ্য সচিব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকান স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বাজার সুবিধা দিলেও এশীয় এলডিসিগুলোকে দিচ্ছে না। এখানে বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
সচিব জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত তুলায় তৈরিকৃত গার্মেন্ট পণ্যে দেশটি যেন শুল্ক সুবিধা দেয় সে প্রস্তাবও দিয়েছি আমরা। এ ছাড়া তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতেও সুবিধা চাওয়া হয়েছে। ইউএসটিআর প্রতিনিধি আমাদের জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার বিষয়টি মার্কিন কংগ্রেসকে অবহিত করবেন।