যেসব কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা উচিত

বাজেট ঘোষণার পর অন্যান্য আলোচনার দৌড়ে পিছিয়ে নেই সঞ্চয়পত্রও। সঞ্চয়পত্র নিয়েও শুরু হয়েছে আলোচনা সমালোচনা। যেকোনো বিচারে হিসেবি বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ খাত হচ্ছে সঞ্চয়পত্র।

পরিবার সব আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ মিলিয়ে হাতে থাকা অর্থ টাকা কোথায় রাখবেন, কোথায় কাজে লাগাবেন তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন অনেকেই। দেশে বিনিয়োগের জনপ্রিয় ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে—পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, জাতীয় সঞ্চয়পত্র, জমি ও স্বর্ণ কেনা, এবং ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখা। সব খাতেই কম-বেশি ঝুঁকি ও সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। তবে বর্তমানে সবচেয়ে নিরাপদে টাকা বিনিয়োগের একটি খাত হতে পারে সঞ্চয়পত্র।

সঞ্চয়পত্র কী?

সঞ্চয়পত্র হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের পরিচালিত একটি বিনিয়োগ প্রকল্প। যেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে নির্ধারিত সময় পরপর মুনাফা পাওয়া যায়। সঙ্গে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে যে টাকাটা বিনিয়োগ করা হয়েছে তাও উত্তোলন করা যায়। অর্থাৎ আপনি ১ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনলেন নিয়ম অনুযায়ী মাসে বা ৩ মাস পরপর আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ পাচ্ছেন, আর এক লাখ টাকা তেমনই থেকে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট মেয়াদের সেই এক লাখ টাকাও ফেরত পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর দেশের নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন স্কিমের সঞ্চয়পত্র দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে— পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র।

কেন বিনিয়োগ করবেন?

এতো কিছু থাকতে কেন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন? এর নিরাপত্তা দেবে কে? উত্তর হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের নিরাপত্তা দেবে স্বয়ং সরকার। সরাসরি সরকার পরিচালিত হওয়ায় এখানে ঝুঁকির পরিমাণ অন্যান্য বিনিয়োগের খাত থেকে অনেকটা কম। আর অন্যান্য বিনিয়োগের মাধ্যমের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হারও বেশি। কখনো জরুরি প্রয়োজন হলে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে নেয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে সুদের হার কিছুটা কমে যাবে। আর রাষ্ট্র বা সরকার এর নিরাপত্তা দেয়ার কারণে অনেকেই বিনিয়োগের জন্য একে ঝামেলামুক্ত ও ঝুঁকিহীন মাধ্যম হিসেবে দেখে।

কারা কিনতে পারবেন?

সবাই সব ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। এ ব্যাপারেও আছে বেশ কিছু শর্ত। একসময় ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তারা সঞ্চয়পত্র কিনতে পারলেও এখন পারেন না। এই চার ধরনের সঞ্চয়পত্রের মধ্যে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ কিনতে পারে দুই ধরনের সঞ্চয়পত্র। তা হলো- পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র।

১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নারী, যেকোনো বাংলাদেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ এবং ৬৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী ও পুরুষেরা শুধু একক নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।

আবার পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন অবসরভোগী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত সরকারি চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরা।

কোথায় পাবেন?

এখন প্রশ্ন আসতে পারে আপনার সঞ্চয়পত্র কিনতে কত টাকা লাগবে বা কোথায় পাবেন এই সঞ্চয়পত্র? অর্থ সঞ্চয়ের জন্য কয়েক লাখ টাকার সঞ্চয় পত্রও কিনতে পারেন আবার ১০ হাজার , ২০ হাজার, ৫০ হাজারের সঞ্চয়পত্রও কিনতে পারেন। ধরন অনুযায়ী বুঝে শুনে সঞ্চয়পত্র কেনা উচিত।

এগুলো কেনা যায় জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের ৭১টি সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যালয়, সব তফসিলি ব্যাংক ও সব ডাকঘর থেকে। একই জায়গা থেকে ভাঙানোও যায়। একসময় সঞ্চয়পত্র কিনতে বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের ছাপানো ফরম পূরণ করতে হতো। সেই দিন ফুরিয়েছে কয়েক বছর আগেই। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রেরই এখন নির্দিষ্ট ফরম রয়েছে, যা ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যায়।

সরকার কেন সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে?

দেশের রাজস্ব আদায়ে যখন অনেক ঘাটতি থাকে। সরকারকে তখন ঋণ নিতে হয়। এজন্য সরকার বিদেশ থেকে যেমন ঋণ নেয় তেমনি দেশের ভেতর থেকেও ঋণ নেয়। দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়ার একটি মাধ্যম সঞ্চয়পত্র বিক্রি।

কিন্তু চলতি বাজেটে আসলে আলোচনাটি এখানেই শুরু হয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না সরকার। যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার চেয়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হচ্ছে বেশি। আবার সঞ্চয়পত্রের জন্য অতি মাত্রায় সুদ পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। যার কারণে বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের আরও নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলেছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কম মূল্যের সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য সরকারের।

কারা কিনবেন না?

সবার জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ সঠিক সিদ্ধান্ত না। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলে তার বিপরীতে জরুরি প্রয়োজনে দুইদিনের নোটিশে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেয়া যায়। কিন্তু সঞ্চয়পত্র জামানত রেখে কোনো ব্যাংকঋণ নেয়া যায় না।

কেউ যদি মনে করেন জরুরি অর্থের দরকার হতে পারে, তার জন্য সঞ্চয়পত্র নয়। কারণ সেখানে লাভ কম, বিনিয়োগটা নষ্ট হওয়ার প্রবণতা থাকে। সে ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র না কেনাই তাদের জন্য উত্তম হবে।

Scroll to Top