Economy

আর্থিক সংকটে ছোট হচ্ছে বাজেটের আকার, চিন্তিত বিশ্লেষকরা

নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে কষ্টে আছে মানুষ। মে মাসেও মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। আছে ডলার–সংকট। এ কারণে পণ্য আমদানি সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। নতুন করে আরেকটি খারাপ খবর এল গতকাল বুধবার। আর সেটি হচ্ছে এক বছর আগের মে মাসের তুলনায় এ বছরের মে মাসে রপ্তানি আয় কমে গেছে ১৬ শতাংশ।

রাজস্ব আয়েও ভালো প্রবৃদ্ধি নেই। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১০ মাসে (জুলাই–এপ্রিল) ঘাটতি আছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। এদিকে মাসের পর মাস ধরে বাড়ছে দেশি-বিদেশি দেনা পরিশোধের চাপ। বিদ্যুতের দেনা পরিশোধের ডলার তো নেই-ই, টাকাও নেই। পাওনাদারদের অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্থ দিতে না পেরে ব্যাংকগুলোকে ৮-১০ বছর মেয়াদি বন্ড দিয়ে সরকার আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও ভিত্তি দুর্বল থাকায় কেউ তা আস্থায় নিচ্ছেন না। তার ওপর আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নানামুখী শর্ত পূরণের চাপ।

এদিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঋণ নেওয়ার হারও ৪০ শতাংশের কাছাকাছি অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় চলে যাচ্ছে। আবার সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বছরে চারবার করে বিদ্যুতের দাম বাড়াবে। পানির দামও কয়েক দিন আগে বাড়ানো হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেও বাড়ানো হলো পেট্রল, অকটেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম।

পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতিতে সুখবর নেই কোনো। চোখের সামনে এমন কোনো সূচক নেই, যা নিয়ে পুরোপুরি সন্তোষ প্রকাশ করা যাবে। নিকট ভবিষ্যতে কোনো সূচক যে ভালো হয়ে যাবে, সে ভরসাও নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও ভিত্তি দুর্বল থাকায় কেউ তা আস্থায় নিচ্ছেন না। তার ওপর আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নানামুখী শর্ত পূরণের চাপ।

আগামী অর্থবছরে কর দেওয়া সাপেক্ষে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক বসানোর প্রস্তাব উঠতে পারে। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই থাকছে।

অর্থনীতিতে এত যে বহুমুখী চাপ, তার প্রভাব পড়ছে বাজেটেও। অন্য বছরগুলোর মতো পাল্লা দিয়ে এবার বাজেটের আকার বাড়ছে না। আগে এক বছর থেকে অন্য বছর বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছিল ১০ শতাংশের বেশি হারে, তবে এবার বাড়ানো হচ্ছে ৫ শতাংশের কম। অর্থের সংস্থান কম থাকায় বাজেট ছোট রাখার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফও। এত সব টানাপোড়েন নিয়েই আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন পাঁচ মাস আগে দায়িত্ব নেওয়া কূটনীতিবিদ হিসেবে বেশি পরিচিত নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

এটি নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। তিনি যে বাজেট বক্তব্য দেবেন, তার শিরোনাম দিয়েছেন সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার। অর্থ মন্ত্রণালয় গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট হলেও টানা চতুর্থ মেয়াদে গঠিত বর্তমান সরকারের এটি প্রথম বাজেট এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ২১তম বাজেট।

নানামুখী সংকটে আছি আমরা। ডলার–সংকট তো আছেই, আছে উচ্চ মূল্যস্ফীতিও। নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঋণের উচ্চ সুদের হার। অথচ মূল্যস্ফীতিও কমল না। এ ছাড়া আছে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা। আমরা চাইব আগামী বাজেটে এ সমস্যাগুলোর সমাধানের ব্যবস্থা থাকবে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম

ইশতেহার কি বিবেচনায় থাকছে
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, টানা চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থমন্ত্রী গত ২৬ মে তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এগুলো হচ্ছে দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা; কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা; লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো।

এ ছাড়া ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি; নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা; সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানোর কথাও বলা হয় ইশতেহারে। সূত্রগুলো জানায়, ইশতেহারের প্রতিফলন বাজেট বক্তব্যে থাকবে।

আমিনুল ইসলাম নামের একজন রিকশাচালক গতকাল বলেন, বাজেট কী তিনি জানেন না। নির্বাচনের আগে তিনি অনেক কথা শুনেছিলেন। এখন জিনিসপত্রের দাম যদি কমে, তাহলেই তিনি খুশি।

আয় কোথা থেকে আসবে
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আগামী বাজেটের আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।

সংশোধিত আকারকে ভিত্তি ধরলে আগামী বাজেটের আকার বাড়ছে ৮২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাড়ানো হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।

আগামী বাজেটে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় আসবে বলে সরকার ধরে নিচ্ছে। এ আয়ের মধ্যে ৪ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে কর। করের মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত অংশ ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআরবহির্ভূত অংশ ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া করবহির্ভূত প্রাপ্তি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ৪৬ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। আর অনুদান পাওয়া যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

ঘাটতি পূরণ (অর্থসংস্থান) করা হবে দুভাবে—বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে নিট ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ অঙ্ক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা থেকে কম হলেও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বেশি।

এত ঘাটতি পূরণ হবে যেভাবে
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অনুদানসহ আগামী অর্থবছরের জন্য আয় হিসাব করা হচ্ছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা কম।

ঘাটতি পূরণ (অর্থসংস্থান) করা হবে দুভাবে—বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে নিট ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ অঙ্ক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা থেকে কম হলেও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বেশি।

আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

ব্যয়ের মধ্যে পরিচালন অংশ ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন অংশ ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। উন্নয়ন অংশের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি থেকে এটি মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা বেশি হলেও সংশোধিত এডিপি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি।

সুদ ব্যয় এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াচ্ছে
আগামী অর্থবছরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সুদ ব্যয় হবে বলে ধরে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেশি অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই বেশি। এর পরিমাণ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে সুদ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা করা হয়। সংশোধিত বাজেটকে ভিত্তি ধরলে সুদ ব্যয়ের বরাদ্দ ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুদ্রানীতির সঙ্গে মিলিয়ে বাজেটের আকার ছোট রাখার সিদ্ধান্তটা ইতিবাচক। সাশ্রয়ী দামে এক কোটি পরিবারের জন্য নিত্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগটাও দরকারি। তবে রাজস্ব ঘাটতি এবং বাজেট ঘাটতি মোটাতে ব্যাংকঋণনির্ভরতা সত্যিই চিন্তার বিষয়। সঞ্চয়পত্র থেকে ভবিষ্যতেও টাকা আসবে না। ফলে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার আয়োজন বাজেট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে।

Scroll to Top