সাধারণ ক্ষমার আওতায় আবারও কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে এ জন্য আগের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি আয়কর দিতে হবে। আগে এই হার ছিল ১০ শতাংশ, এবার তা হচ্ছে ১৫ শতাংশ। এ প্রক্রিয়ায় টাকা বৈধ করলে সরকারের কোনো সংস্থা কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারবে না। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ প্রস্তাব থাকতে পারে। দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, কোনো করদাতার স্থাবর সম্পত্তি যেমন—ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।
এই বিধানের যুক্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থনীতিতে কার্যকর চাহিদা সৃষ্টি এবং সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে হবে।
ডাটা ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালুর পর বিভিন্ন কম্পানির অপ্রদর্শিত আয় ও পরিসম্পদ প্রদর্শনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রিটার্ন দাখিলে করদাতার অজ্ঞতাসহ অনিবার্য কিছু কারণে অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এই অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নে এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ দিয়ে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না, সর্বোচ্চ স্লাব ৩০ শতাংশ
বর্তমানে ৩৭ লাখ ব্যক্তি শ্রেণির করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে বড় অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির করদাতা। এই শ্রেণির করদাতাদের জন্য বাজেটে আয়কর খাতে ছাড় থাকছে না। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও আয়কর আদায়ের কথা চিন্তা করে বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। পরবর্তী এক লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, এরপরের চার লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ ও পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ কর অপরিবর্তিত রয়েছে।
তবে এর পরবর্তী ২০ লাখ টাকার ওপর ২৫ শতাংশ কর দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য বাজেটে বিত্তশালীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের পদক্ষেপ থাকছে। বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ রয়েছে। এটিকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।
তালিকাভুক্ত কম্পানির করপোরেট কর বাড়ছে
বর্তমানে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করহারের মধ্যে পার্থক্য ৭.৫০ শতাংশ। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে এই পার্থক্য কমে দাঁড়াতে পারে ৫ শতাংশ। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি যাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি আইপিওর (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) মাধ্যমে হস্তান্তর হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে করপোরেট করহার ২০ শতাংশ। তবে আগামী বাজেটে এই করহার বেড়ে দাঁড়াবে ২২.৫০ শতাংশে। অন্যদিকে পাবলিকলি ট্রেডেড নয় এমন প্রতিষ্ঠানের করহার অপরিবর্তিত রয়েছে। তাদের করহার ২৭.৫০ শতাংশ।
রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা বাড়ছে, অ্যাসেসমেন্ট বাতিল
বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি সেবা নিতে হলে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। এই তালিকা আরো বাড়ছে। এখন থেকে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মোটেল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন এবং কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল বা সমজাতীয় কোনো সেবা নিতে গেলেও রিটার্ন জমার সনদ লাগবে। এ ছাড়া ব্যবসা স্থানে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ প্রদর্শনের ব্যর্থতায় সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা রাখা হয়েছে।
তবে করদাতার হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে আয়কর আইনে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রত্যক্ষ করব্যয় এক লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা
২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করব্যয়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৩.৫৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কম্পানি পর্যায়ে ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ও ব্যক্তি পর্যায়ে ৪৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ২.৯১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই করব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা।
কমছে কর অব্যাহতি
কর অব্যাহতি যৌক্তিক করতে শুধু সরকারি হাই-টেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে সুবিধা দেওয়া হবে। অব্যাহতিপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি মার্জার, ডিমার্জার ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে পুনর্গঠিত হলেও কর অব্যাহতি পাবেন না। পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল উত্তোলনে নিয়োজিত কম্পানিগুলোর নিঃশেষ ভাতা অননুমোদন, তালিকাভুক্ত কোনো কম্পানির শেয়ার বা ইউনিট থেকে ব্যক্তি করদাতার ৫০ লাখ টাকার বেশি কোনো মূলধনী আয় হলে ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদ আয়ে ১০ শতাংশ কর বৃদ্ধি
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও কম্পানির আওতায় ফেলে বাজেটে ২০ শতাংশ কর কর্তনের বিধান করা হচ্ছে। আগে এই হার ছিল ১০ শতাংশ। অন্যদিকে স্বীকৃত ভবিষ্যতহবিল, অনুমোদিত আনুতোষিক তহবিল, অনুমোদিত বার্ধক্য তহবিল ও পেনশন তহবিলের ক্ষেত্রে করহার কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
কঠিন শর্তে আইসিটি খাতে তিন বছর কর অব্যাহতি
তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ২৭টি উপখাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ৩০ জুন। তবে শতভাগ ক্যাশলেস লেনদেন করার শর্তে ১৯টি উপখাতকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। উপখাতগুলো হলো এআই বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, ব্লকচেইন বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, ডিজিটাল ডাটা এনালাইটিক্স ও ডাটা সাইয়েন্স, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও কাস্টমাইজেশন, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট ও সার্ভিস, আইটি সহায়তা ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস, ডিজিটাল এনিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডাটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং, ই-লার্নিং প্ল্যাটফরম ও ই-পাবলিকেশন, আইটি ফ্রিল্যান্সিং, কল সেন্টার সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং।
সারচার্জ ও পরিবেশ সারচার্জ অপরিবর্তিত
বিত্তবান ব্যক্তি করদাতাদের নিট পরিসম্পদের মূল্যমান চার কোটি টাকা পর্যন্ত সারচার্জ শূন্য। চার কোটি টাকা অতিক্রমে ১০ শতাংশ ও ৫০ কোটি টাকা অতিক্রম করলে সারচার্জের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া একাধিক গাড়ি থাকলে সিসিভেদে ২৫ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত পরিবেশ সারচার্জের বিধানও অপরিবর্তিত থাকছে। এতে সুবিধা পাবেন ধনী করদাতারা।
নিত্যপণ্যে কর কর্তনের হার ১ শতাংশ
ধান, গম, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুটি, ছোলা, মসুর ডাল, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, মোটা আটা, আটা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনি, দারচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, পাট, তুলা ও সুতা ক্রয়ের জন্য ঋণপত্র খোলা বা অন্য কোনো অর্থায়ন চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর কর্তনের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে আগামী বাজেটে। এতে স্বস্তি পাবেন সাধারণ মানুষ।
কার্বোনেটেড বেভারেজে টার্নওভার কর বাড়ছে
পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্য ব্যয় কমাতে মিষ্টি পানীয় উৎপন্ন হতে আয়ের ওপর বিদ্যমান হার ০.৬ শতাংশের পরিবর্তে কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার কর আরোপের প্রস্তাব করা হতে পারে আগামী বাজেটে।