ব্যাংকের কোনো কর্মী কোনো ব্যবসায়ে জড়াতে পারবেন না

প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারবেন না ব্যাংকাররা। পেশাগত দায় সৃষ্টি হয়, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এমন কোনো উপঢৌকন গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কাজে লাগানো যাবে না পোশাগত সুবিধা আদায়ে রাজনৈতিক বা পর্ষদের প্রভাব। কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ব্যাংকের কোনো কর্মী অন্য কোনো ব্যবসা বা কর্মে জড়াতে পারবেন না। অর্থাৎ স্বার্থের সংঘাত থেকে বিরত থাকতে হবে।

ব্যাংকারদের আচরণের এসব দিক সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল প্রকাশিত ‘কোড অব কন্ডাক্ট ফর ব্যাংকস অ্যান্ড নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস’ শীর্ষক এ নীতিমালার আলোকে দেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংককে এর আলোকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব আচরণবিধি তৈরি করতে বলা হয়েছে। আগামী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ আচরণবিধি পরিপালন করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
সরকার প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নীতিমালাটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সততা, নৈতিকতা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নীতিমালাটি তৈরিতে উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. আবুল কালাম আজাদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নীতিমালায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি পরিপালন হলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা বাড়বে। নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত পরিবেশে ব্যাংকাররা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

ব্যাংকারদের পেশাগত পরিচয়ের অপব্যবহার বন্ধের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নীতিমালায়। এতে বলা হয়েছে, পেশাগত পরিচয় বা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে ব্যাংকাররা অন্য কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা নিতে পারবেন না। এমনকি বাড়িভাড়া, গাড়ির লাইসেন্স গ্রহণ বা নবায়ন এবং ফ্ল্যাট ও অন্যান্য সম্পত্তি ক্রয়ের মতো ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও পেশাগত পরিচয় বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ব্যবহার তাদের জন্য নিষিদ্ধ।

সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে উপহারসামগ্রী গ্রহণের অভিযোগ পুরনো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় যাথযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের উপহারসামগ্রী গ্রহণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যাংকার অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কোনো উপহারসামগ্রী গ্রহণ করবেন না, যাতে তার নিজের পেশাগত দায় সৃষ্টি হয়। এমনকি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজ পরিবারের সদস্যদেরও এ ধরনের উপহার গ্রহণ করতে দেবেন না ব্যাংকার। পোস্টাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে যদি এ ধরনের কোনো উপহারসামগ্রী আসে, তাহলে ব্যাংকার তা গ্রহণ করবেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রাতিষ্ঠানিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ওই উপহারসামগ্রী হস্তান্তর করতে হবে।

ব্যাংকারদের পেশাগত দায় তৈরি করে, এমন কোনো ঘটনা প্রতিষ্ঠানের নজরে এলে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে নীতিমালায়। এছাড়া কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রধান বা তার প্রতিনিধি কোনো ব্যাংকারকে উপহার দিতে চাইলে, কোনো ধরনের অবমাননা করা ছাড়াই তা এড়ানোর প্রচেষ্টা চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি যদি এড়ানো সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ব্যাংকারদের।

শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে এড়ানো যায়, সেজন্য ব্যাংকারদের কয়েকটি কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল জারি করা ওই নীতিমালায় প্রতিষ্ঠানের খরচে ব্যক্তিগত উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তিগত সুবিধাসংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠানকে এমন কোনো উপদেশ, পরামর্শ বা নির্দেশনা দেয়াও যাবে না, যা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্য থেকে শেয়ার ধারণ, মুনাফা ভাগাভাগি অথবা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এমনকি নেয়া যাবে না নিজের বা পরিবারের স্বার্থ উদ্ধারে প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরিচয় গোপন রেখে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক বা অনৈতিক সুবিধাও। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো চাকুরে যদি নিজস্ব ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালাতে চান, সেক্ষেত্রে তা অবশ্যই শুধু চাকুরের নিজ পরিবারের সদস্যদের দিয়ে পরিচালিত হতে হবে। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবহিত করার পাশাপাশি নিজস্ব ছোট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সম্পদের পূর্ণ ঘোষণাসংবলিত তথ্য দিতে হবে।

জাতীয় সংসদ বা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের হস্তক্ষেপে ব্যাংকারদের পেশাগত বা ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে নীতিমালায়। এতে বলা হয়েছে, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, পদোন্নতি, বদলি কিংবা ব্যক্তিগত কোনো সুবিধা আদায়ের জন্য কোনো ব্যাংকার সংসদ সদস্য বা পরিচালনা পর্ষদ সদস্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ করতে পারবেন না।

গ্রাহক তথ্যের নিরাপত্তার ওপরও বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে নীতিমালায়। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ও লেনদেনের যেকোনো বিবরণ সর্বোচ্চ নিরাপত্তার সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে। উপযুক্ত ও আইনসিদ্ধ কর্তৃপক্ষ বা আদালতের আদেশ ছাড়া এ ধরনের তথ্য প্রকাশ কিংবা বিনিময় করা হলে তা হবে নৈতিক মানদণ্ডের গুরুতর লঙ্ঘন। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তা হবে চুক্তিভঙ্গের শামিল।

আইনসিদ্ধ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তৃতীয় কোনো পক্ষকে প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত কোনো তথ্য দিতে পারবেন না। নিজ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, কৌশল, ব্যবস্থা ও নীতি সম্পর্কিত কোনো তথ্যও ফাঁস করতে পারবেন না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্তরা।
গ্রাহকসেবার বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক কার্যক্রম দেখা গেলে গ্রাহককে সে বিষয়ে নিয়মিত অবহিত করতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের পণ্য ও সেবাগুলো সম্পর্কেও গ্রাহকদের পূর্ণরূপে তথ্য জানাতে হবে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই কোড অব কন্ডাক্ট মেনে চলছে বলে জানান ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ. খান। তিনি বলেন, তার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে যে নীতিমালা দিয়েছে, তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। ঘোষিত নীতিমালার আলোকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হলে দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। নীতিমালাটি সব প্রতিষ্ঠান যাতে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়ানো যেতে পারে।

তথ্য উৎসঃ বণিক বার্তা। 

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, ০৭  নভেম্বর  ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এস