আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে লোকসানের হাত থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বাঁচাতে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। ফলে বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চার হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। তবে, যথেষ্ট মুনাফা ও বিশ্ববাজারে তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকার পরও দেশের বাজারে কমছে না জ্বালানি তেলের দাম।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। আমদানির মাধ্যমে বাকি চাহিদা পূরণে কাজ করে বিপিসি। অপরিশোধিত তেল আমদানি করা হয় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে পরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়।
বিপিসির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ ৫১ হাজার টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে বিপিসি। এর মধ্যে রয়েছে ছয় লাখ ৮২ হাজার টন মারবান ক্রুড ও আট লাখ ৬৯ হাজার টন অ্যারাবিয়ান ক্রুড। আমদানিবাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।
এ ছাড়া, ৪০ লাখ ৩৬ হাজার টন ডিজেল, প্রায় তিন লাখ ৩৭ হাজার টন মোগ্যাস, চার লাখ ৭৮ হাজার টন জেট ফুয়েল, প্রায় চার লাখ ৩৬ হাজার টন ফার্নেস অয়েল ও ৩০ হাজার টন মেরিন ফুয়েল আমদানি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে সংস্থাটি এ সময় মোট পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করেছে প্রায় ৫৩ লাখ ১৭ হাজার টন, যার আর্থিক মূল্য ৫১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
করোনা-পরবর্তীতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে লোকসানের মুখে পড়ে বিপিসি। সেবার ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই হাজার ৭০৫ কোটি টাকা লোকসান করে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এর আগে থেকে লাভের মুখেই ছিল বিপিসি। গত নয় বছরে বিপিসির মুনাফার পরিমাণ ৪২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার হাজার ২১২ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাত হাজার ৭৫৩ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৫৫১ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছয় হাজার ৫৩৩ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৪৬ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৬৫ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে নয় হাজার ৯২ কোটি টাকা মুনাফা করে বিপিসি। এর মধ্যে কেবল ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। এমন মুনাফা সত্ত্বেও লোকসানের হাত থেকে বিপিসিকে বাঁচাতে ২০২২ সালে রেকর্ড পরিমাণ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে সরকার। ফলে শেষ অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ মুনাফার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ১৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা জমা দেয় সংস্থাটি। সবমিলিয়ে গত নয় বছরে মোট এক লাখ ৫৯৭ কোটি টাকা সরকারের নিকট জমা দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ২২৯ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছয় হাজার ২১৯ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নয় হাজার ২৪৮ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নয় হাজার ৯৭ কোটি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নয় হাজার ৫৯০ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১৪৬ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৭৭৮ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিসি লোকসান করা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছিল ১৫ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।
তবে, বিপিসির মুনাফা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের সুফল পাচ্ছে না জনগণ। বিগত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ওঠা-নামা করছে ৭০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে। গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ছিল ৮০ দশমিক ৬৫ ডলার। এতে করে বিপিসিরও মুনাফা হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনাফা নয় বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণের নিকট পণ্য সরবরাহ করা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ আহমেদ বলেন, সরকার যখন দাম বাড়ায়, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল ঠিকই। কিন্তু সেটা স্বল্প সময়ের জন্য ছিল। ওই দামের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ানো হলো। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম যখন কমলো, তখন দেশের বাজারে কমানো হলো না। জ্বালানি খাতের গ্রাহকরা এমনিতে প্রচুর চাপে আছেন। তারা কিন্তু মার্কেট প্রাইসে পণ্যটা পেলে খুশি হয়। এদিকে, আইএমএফও জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ফর্মুলায় যাওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। সুতরাং সরকারের উচিত সার্বিকভাবে একটি সহনশীল মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় যাওয়া।
আইএমএফের শর্ত ও স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণে ভোক্তা কতটুকু উপকৃত হবেন
সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিকট ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ। তবে, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আইএমএফ শর্ত প্রদান করে যে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে ফেলতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমায় সরকার।
এ ছাড়া, প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয়ের বিষয়টিও অন্যতম একটি শর্ত ছিল। গত ডিসেম্বর মাসেই আইএমএফ এ পদ্ধতি চালু করার কথা বললেও জাতীয় নির্বাচন থাকায় তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে, প্রস্তাবনাটি চূড়ান্ত করতে বর্তমানে অর্থ ও জ্বালানি বিভাগ আলোচনা করছে।
এ ফর্মুলায় জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় হিসাব করা হবে যেদিন মূল্য পরিশোধ করা হবে, সেদিনের বিনিময় হার অনুযায়ী। এর সঙ্গে শুল্ককর, ডিলার কমিশন, বিপিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্য ব্যয়, পরিচালন ব্যয় ও পরিবহন ফি এবং কিছু মুনাফা যুক্ত করে তেলের দাম নির্ধারিত হবে। ইতোমধ্যে এ ফর্মুলায় সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের পাশাপাশি ১০ শতাংশ মুনাফা দাবি করেছে বিপিসি। ফলে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে গ্রাহক কতটুকু উপকৃত হবেন, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে কাজ করছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকি থেকে বের করে আনাই সরকারের লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের জ্বালানি তেলের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি স্বয়ংক্রিয় জ্বালানি-মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে। এ পরিকল্পনার আওতায় প্রতি মাসে একবার পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম সমন্বয় করা হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় ফর্মুলায় তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজন সরকার ও বিপিসির যৌথ সমন্বয়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ আহমেদ বলেন, স্বয়ংক্রিয় ফর্মুলায় তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার ও বিপিসিকে একটা সমন্বয়ের মধ্যে আসতে হবে। সরকার তার নির্ধারিত ট্যাক্স এবং বিপিসি তার অপারেশনাল খরচটুকু নিলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য যখন বৃদ্ধি পাবে, তখন জনগণের ওপর চাপটা অধিক হয়ে দাঁড়াবে না। আর সরকার ও বিপিসি যদি তাদের ইচ্ছামতো পার্সেন্টেজ প্রয়োগ করে, তাহলে এ ফর্মুলার সঠিক উপযোগিতা ভোক্তারা পাবেন না।