পানির দরে সোনা মিলছে দেশে! প্রতি ভরি সোনার দাম ক্ষেত্রভেদে এক থেকে ৫ হাজার টাকা মাত্র! কোথাও আবার ভরি মিলছে হাজার টাকারও কম! তবে এমন দাম স্বর্ণের বাজারে নয়, বরং মিলেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জমা দেয়া প্রার্থীদের হলফনামায়। এগুলো আবার নোটারি করে জমা দেয়া। অথচ বর্তমান বাজারে স্বর্ণের ভরি লাখ টাকার উপরে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রার্থীদের অর্থ-সম্পদ বিবরণী শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য নয়, বরং যে কোনো ধরনের অসংগতির জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের নিয়মে সম্পদের হিসাব দাখিল করলেও সম্পদের মূল্য কম দেখানো আইনসম্মত নয়। এসব বিষয়ে যদি দুদকে অভিযোগ ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত আসে, তাহলে দুদক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ ছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্টদের আয়কর রিটার্নের সঙ্গে হলফনামার তথ্যের কোনো গরমিল আছে কি না সেটা খতিয়ে দেখতে পারে।
প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনায় দেখা যায়, জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান দুলাল ইসিতে জমা দেয়া হলফনামায় নিজ নামে ১৫ ভরি স্বর্ণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন। এর দাম দেখিয়েছেন ৬৫ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি ভরি দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৩৩ টাকা। সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনের সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্ত নিজের নামে ১০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে বলে জানান। সেটির দাম দেখিয়েছেন তিনি ৪০ হাজার টাকা। প্রতি ভরির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার টাকা। সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বিবাহ সূত্রে প্রাপ্ত ১০০ ভরি সোনার দাম দেখিয়েছেন মাত্র এক লাখ টাকা। ভরি প্রতি সোনার দাম পড়েছে এক হাজার টাকা।
হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আব্দুল মজিদ খান এবার নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তার নামে থাকা ১০ ভরি স্বর্ণ, যার মূল্য দেখিয়েছেন তিনি ৪০ হাজার টাকা। ময়মনসিংহ-২ আসনের সংসদ সদস্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ তার স্ত্রীর নামে থাকা ১০ ভরি সোনার দাম দেখিয়েছেন ৮০ হাজার টাকা। ফেনী-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারীর নামে ৩০ ভরি, আর স্ত্রীর নামে রয়েছে ১০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। প্রতি ভরি সোনার দাম ধরা হয়েছে এক হাজার টাকা।
রাঙামাটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রিটার্নিং অফিসারের কাছে হলফনামা দিয়েছেন বর্তমান এমপি (সংসদ সদস্য) দীপংকর তালুকদার। নিজের নামে ২৫ ভরির স্বর্ণ থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ করলেও তার দাম দেখিয়েছেন আড়াই লাখ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী নিজের নামে বিবাহকালীন সময়ের ৩০ ভরি স্বর্ণ দেখিয়েছেন। অর্জনকালীন যার মূল্য উল্লেখ করেছেন ৯০ হাজার টাকা। এই হিসাবে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম পড়েছে ৩ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর নামে স্বর্ণ রয়েছে ৫৮ ভরি। অবশ্য স্ত্রীর স্বর্ণের মূল্য কিছুটা বেশি ১৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম পড়েছে ২২ হাজার ৮১০ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা স্ত্রীর নামে ৭ ভরি এবং নির্ভরশীলদের নামে ৩৫ ভরি স্বর্ণ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে স্ত্রীর নামে থাকা স্বর্ণের মূল্য দেখিয়েছেন ৩৫ হাজার টাকা এবং নির্ভরশীলদের স্বর্ণের মূল্য দেখিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী তারেক আহমেদ আদেল নিজের নামে দেখিয়েছেন ৪৫ ভরি স্বর্ণ; যার মূল্য ৭৫ হাজার ৩২০ টাকা।
লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর-সদর আংশিক) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন এবারও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার কাছে ১০ তোলা (ভরি) সোনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যার মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। আর তার স্ত্রী চৌধুরী রুবিনা ইয়াসমিন লুবনার ৫০ তোলা (ভরি) সোনার মূল্য দেখানো হয়েছে ২ লাখ টাকা (প্রতি ভরি ৪ হাজার টাকা)।
স্বর্ণের বাজারের এমন অবস্থার সময় বরিশাল-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার কাছে থাকা উপহার হিসেবে পাওয়া ৫০ ভরি স্বর্ণের দাম হলফনামায় উল্লেখ করেছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। বরিশাল-৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল হাফিজ মল্লিক তার নিজের ৩০ ভরি স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন মাত্র ৪০ হাজার টাকা। আসনটির স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সামসুল আলম ও জাসদ প্রার্থী মো. মোহসিন তাদের কাছে থাকা স্বর্ণের দাম দেখিয়েছেন মাত্র ২ হাজার টাকা ভরি। বরিশাল-৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী তার কাছে থাকা ১৩০ ভরি স্বর্ণের দাম হলফনামায় উল্লেখ করেছেন প্রতি ভরি ৭ হাজার টাকা দরে।
জানা গেছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনসহ কয়েকটি এনজিও গত কয়েকটি নির্বাচনে হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করলেও কোনো ফল হয়নি। কোনো কর্তৃপক্ষকে আজও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রার্থীদের হলফনামায় আয়-ব্যয় সংক্রান্ত সবকিছু খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে বিধায় এই প্রবিশনটা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হয় তারা ক্ষমতায় গিয়ে কিংবা ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।’