খড় হোগলা কচুরিপানা দিয়ে তৈরি বাংলাদেশি পণ্য যাচ্ছে ২৬ দেশে

ধানের খড়, পাট, হোগলা ও কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ম্যাট, পাপস, টুপি, ফুলের টপ, ব্যাগসহ শতাধিক রকমের পণ্য। রাজবাড়ীর গোল্ডেন জুট প্রোডাক্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরবসহ ২৬ দেশে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানটিতে দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন প্রতিবন্ধীও রয়েছেন। তাদের চোখেমুখেও এখন স্বপ্ন খেলা করে।

গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রাজবাড়ী শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বরাট ইউনিয়নের ভবদিয়া এলাকার অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মো. হাকিম আলী সরদার। নিজের এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এমন কিছু করার চিন্তা থেকে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি। নিজের তিন একর জমি, জমানো কিছু টাকা ও ইসলামী ব্যাংকের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন গ্লোবাল গোল্ডেন জুট অ্যান্ড ক্রাফট লিমিটেড। বর্তমানে এটি গোল্ডেন জুট প্রোডাক্ট নামে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে নিয়মিত কাজ করছেন ৮০০ শ্রমিক। আর চুক্তিভিত্তিক বাহিরে কাজ করছেন আরও ১২০০-এর বেশি শ্রমিক। যাদের বেশিরভাগই সর্বনাশা পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন।

কয়েকদিন আগে সরেজমিন গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টে গিয়ে দেখা যায়, পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে কাজ করছেন নারীরা। কালাম মিয়া নামে এক শ্রমিক জানান, তিনি একসময় ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ঢাকায় যে বেতন পেতেন, রাজবাড়ীতেও তাই পাচ্ছেন। ঢাকায় বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ করে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। আর এখানে নিজের বাড়িতে থেকে প্রতিষ্ঠানের পরিবহনে এসে কাজ করতে পারছেন। এখন অনেক ভালোভাবে কাটছে দিন।

রেহেনা পারভীন শারীরিক প্রতিবন্ধী। পায়ের সমস্যা থাকলেও হাত দুটো ভালো। তার স্বামীও প্রতিবন্ধী। এ কারণে কেউ কোনো কাজ দিতে চাইত না। চার সন্তান নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটত। পরে গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টে কাজ শুরু করেন। সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ভালোই চলছে তাদের।

আরেক প্রতিবন্ধী শ্রমিক সোহেল রানা বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার কারণে আমার মতো একজন প্রতিবন্ধী দুই বেলা দু-মুঠো ভাত খেতে পারছি। পরিবারের খরচ মিটিয়ে নিজেও স্বাবলম্বী হচ্ছি।

শ্রমিক হাসি আক্তার বলেন, আগে স্বামী একা কাজ করত। এখন আমিও করি। দুজনের আয় দিয়ে সংসার ভালোভাবে চলছে। সন্তানদের পড়াশোনা করাতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না।

শ্রমিক স্মৃতি আক্তার বলেন, সর্বনাশা পদ্মার ভাঙনে ঘরবাড়ি জমি সব হারিয়েছি। বাড়ির কাছের এ কারখানায় চাকরি করে এক বছরে ৮৫ হাজার টাকা জমিয়েছি। এক খণ্ড জমি কিনে ঘর তোলার স্বপ্ন দেখছি। আমার মতো অনেক নারী এখানে কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন।

গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টের মহাব্যবস্থাপক মো. আলাউদ্দিন শুভ বলেন, আমাদের উৎপাদিত বেশিরভাগ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে থাকি। কারণ বিদেশে পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের চাহিদা বেশি। ক্রেতারা অর্ডার করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা প্রোডাক্ট পাঠিয়ে থাকি। পণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ায় দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের পণ্য বিশ্বের ২৬ দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টের ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে এতদিন পাট-হোগলা দিয়ে নানান ধরনের পণ্য তৈরি হতো। এ বছর যুক্ত হয়েছে ধানের খড় ও কচুরিপানা। আমরা গ্রামপর্যায়ে থেকে খড় ও কচুরিপানা কিনে এনে সেগুলোও ব্যবহার উপযোগী বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করছি। রাজবাড়ীতে প্রচুর পাট চাষ হয়। তাই এ জেলা থেকে পাট ক্রয় করা হয়। আর হোগলা কিনে আনা হয় কুমিল্লা থেকে। এলাকার প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ ও অসহায়রা এখানে কাজ করছেন। যিনি যে ধরনের কাজ করতে পারছেন, তাকে সেই ধরনের কাজ দিয়েই কর্মসংস্থান তৈরি করা হয়েছে।

রাজবাড়ীর বিসিক শিল্প নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক চয়ন বিশ্বাস বলেন, বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা হচ্ছে। আর গোল্ডেন জুট প্রোডাক্টের পণ্য রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।

রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক আবু কায়সার খান বলেন, উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। কারখানা এলাকায় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক খেয়াল রাখা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য ব্যবহারে সবাইকে আগ্রহী করে তুলতেও কাজ করা হচ্ছে।