শীতের সাতসকালে চৌগাছা উপজেলা পরিষদ চত্বরে গুড়-পাটালি নিয়ে এসেছিলেন সলুয়া গ্রামের রশিদ শেখ ও পুড়াপাড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ। শীত মৌসুম এলেই তারা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন এবং গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন। প্রায় চার দশক ধরে তারা তৈরি করেন গুড়-পাটালি। বিক্রি করেন স্থানীয় হাটবাজারে। কিন্তু সোমবার গুড়-পাটালি নিয়ে এসেছিলেন চৌগাছা উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘ঐতিহ্যবাহী খেঁজুর গুড়ের মেলায়’। তার মতো প্রায় দুই শতাধিক গাছি মেলায় এসেছিলেন গুড়-পাটালি নিয়ে। তাই তো অন্যদিনের চেয়ে উপজেলা পরিষদের পরিবেশটা ছিল অন্যরকম। গুড়-পাটালির সুবাসে ভরে উঠে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গন। ভেজালমুক্ত গুড়ের ঘ্রাণে উপস্থিত দর্শকদের মনে ভরে উঠে।
তবে অন্য সময়ের মতো গাছিদের মনটা কিছুটা ছিলো ভারি। গুড় পাটালির দাম নিয়ে তারা খুশি নন। এদিন মেলায় ৩০০ টাকা করে কেজি গুড় বিক্রি করেছেন। তাদের দাবি কেজি প্রতি অন্তত দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা হওয়া উচিৎ। কারণ রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করা অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। এছাড়া বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়েছে। সেই তুলনায় বাড়েনি গুড়ের দাম।
মেলায় অংশ নেওয়া চৌগাছার ফতেপুর গ্রামের শাহাদাত আলী, দিঘলি গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও সঞ্চাডাঙ্গা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তারা বংশ পরম্পরায় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। কিন্তু খেজুরের রস-গুড়ের সঠিক দাম না পাওয়ায় দিনদিন গাছ ও গাছি কমে যাচ্ছে। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করা উচিৎ। প্রয়োজনে গুড়-পাটালি বিদেশ রপ্তানি করবে হবে। কিন্তু প্রশাসন খেজুরের গুড়কে যশোর জেলার অন্যতম ব্রান্ডিং পণ্য করলেও দাম নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শোনা যায়নি।
ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থ মতে, এক সময় যশোর অঞ্চলের প্রধান কৃষিপণ্য ছিল খেজুরের গুড়। ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের নিউ হাউস চৌগাছার তাহেরপুরে খেজুরের গুড় থেকে ব্রাউন সুগার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সে সময় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ছাড়াও চিনি রফতানি হত ইউরোপে।
চৌগাছার কাবিলপুর গ্রামের মসলেম আলী বলেন, সরকার উদ্যোগ নিলে অতীতের মতো এখনো গুড় বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এতে গাছ রক্ষা ও গাছিদের রস সংগ্রহের আগ্রহ বাড়বে।
এদিকে খেজুর গাছ রক্ষা, গাছিদের সম্মান দেয়া ও উৎপাদিত গুড় সঠিক দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে দুই দিনব্যাপী খেজুর গুড়ের মেলার আয়োজন করেছে চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন। মেলার উদ্বোধন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে চৌগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ড. মোস্তানিছুর রহমান ও চৌগাছা পৌরসভার মেয়র নূর উদ্দিন আল-মামুন হিমেল মেলা ঘুরে দেখেন। তাদের কাছেও গাছিরা দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা জানান, যশোর জেলা খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত হলেও নানা কারণে খেজুর গাছ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এবং গাছিদের উদ্বুদ্ধ করতে এই খেজুর গুড়ের মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
চৌগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ড. মোস্তানিছুর রহমান বলেন, গাছিদের অভিযোগ দিনের পর দিন খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তিরা খেজুর গাছ কেটে ইট ভাটায় নিয়ে জ্বালানির কাজে ব্যবহার করছে। খেজুর গাছ টিকিয়ে রাখতে সরকার যদি সড়কের পাশে খেজুর গাছ রোপনের উদ্যোগ নেয় তাহলে ভালো হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আবু তোহার তথ্য মতে, জেলায় বর্তমানে ১৭ লক্ষ ২১ হাজার ৮৪৩টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস হয় তিন লক্ষ ২১ হাজার ৮২৯টি গাছ থেকে। গাছি আছে ১৬ হাজার ২২৬ জন। এবার ৫২ লক্ষ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি গুড় উৎপাদানের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।