একদিনের ব্যবধানে গতকাল সোমবার রাজধানীর খুচরা বাজারে আরও ১০ টাকা বেড়েছে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম বেড়েছে পাঁচ টাকা। গত এক সপ্তাহের হিসাব ধরলে দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কেন?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই, সবই সিন্ডিকেটের কারসাজি। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, প্রতি বছর দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় তা দিয়ে চাহিদা মেটে না। চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করে মেটাতে হয়। ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে অতিবৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হয়েছে। এতে বুকিং রেট বাড়ায় দেশে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম বেশি পড়ছে।
তবে ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর এই অজুহাত মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, প্রতি বছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ লাখ টন।
এরমধ্যে দেশে উৎপাদন হচ্ছে ৩৩ লাখ টন। সংরক্ষণের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হলেও বাকি থাকে ২৩ লাখ টন। আর প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ফলে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ সবসময় উদ্বৃত্ত থাকে। তাই হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।
সূত্র বলেছে, ভারত, মিয়ানমারসহ অন্যান্য যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ পেঁয়াজ আমদানি করে থাকে, সেসব দেশ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেনি। এছাড়া বড় কোনো সমস্যাও নেই। তাহলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেন ১৫ থেকে ২০ টাকা বাড়বে? এটা সিন্ডিকেটের কারসাজি ছাড়া কিছুই না।
গতকাল রাজধানীর কাওরানবাজার ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একদিন আগে গত রবিবার এই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৫০ থেকে ৬৫ টাকা ও ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায়। আর এক সপ্তাহ আগে তা বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা ও ৩৮ থেকে ৪৫ টাকায়।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৪৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।
হাকিমপুর (দিনাজপুর) বন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ভারতে বুকিং রেট বৃদ্ধি অন্যদিকে অতিরিক্ত গরমে অপরিপক্ক পেঁয়াজ আমদানি করে লোকসানের আশঙ্কায় আমদানির পরিমাণ কমেছে। যার ফলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখী ।
গতকাল হিলি বন্দরের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারিতে দুই দিন আগে যে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে সেই পেঁয়াজ এখন কেজিতে ১২ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়।
বন্দরের ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, প্রতিদিন এই বন্দরে ৫০ ট্রাক পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে সেখানে বর্তমানে আমদানি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ ট্রাক। গত দুই সপ্তাহে এই বন্দর দিয়ে ১৭২ ট্রাকে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ গতকাল জানান, চাহিদার তুলনায় বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দামটা বেড়েছে। এটা আসন্ন দুর্গা পূজা পর্যন্ত থাকতে পারে। আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি।
খুলনা অফিস জানিয়েছে, খুলনার বাজারে প্রকারভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ১০ টাকা বেড়েছে। নগরীর সোনাডাঙ্গাস্থ ট্রাক টার্মিনালের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী ও ফারাজী ভান্ডারের কর্মকর্তা মো. মোকাদ্দেস হোসেন গাজী জানান, এ বাজারে প্রতিদিন প্রায় ছয় ট্রাক পেঁয়াজের প্রয়োজন। সেখানে দুই ট্রাক করে পেঁয়াজ আসছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে উত্পাদন বাড়িয়ে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে জোর দিয়েছে সরকার। গত ৬ বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে।
গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৩০ লাখ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৫৩ লাখ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৩০ লাখ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৩০ লাখ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৫ দশমিক ৬০ লাখ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৬২ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে।
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে পেঁয়াজের দাম কেন বাড়ে?
দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হয় ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে মুড়িকাটা (আগাম) পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করে। আর মার্চে বীজ থেকে উত্পাদিত পেঁয়াজ বাজারে আসে।
বলা যায়, এটাই পেঁয়াজের মূল মৌসুম। এ সময় পেঁয়াজের দাম অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা কমে আসে বলে জানান পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা। এ সময় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষে জোর দিলে এ সমস্যা থাকবে না বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।
তবে পেঁয়াজে ভারতনির্ভরতাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) এক গবেষণায় বলেছে, অক্টোবর ও নভেম্বরে পণ্যটির বাজারে সরবরাহ রাখা নিয়ে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। উপকরণ সহায়তা ও সমন্বিত নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে উত্পাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এ সংকটকে সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব।