গত ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত জানা যায়নি দেশের কোথাও ওই দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির খবর। বেসরকারি খাতের ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডার এখনো বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকা থেকে ১১শ টাকায়। অথচ ৯৭৫ টাকা বিইআরসির নির্ধারিত দাম।
নির্ধারিত দামে কোম্পানিগুলো এলপিজি বিক্রি করছে না। উল্টো এলপিজি অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এলপিজির দাম বাড়াতে বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে। জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তবে বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, লোয়াব ও বিইআরসির ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের মূল্য বিবেচনায় আজ বৃহস্পতিবার বিইআরসি এলপি গ্যাসের নতুন মূল্য ঘোষণা করবে।
রান্নার জন্য বেসরকারি খাতের ১২ কেজির সিলিন্ডার ৯৭৫ টাকা ও ৪৫ কেজির সিলিন্ডার ৩ হাজার ৬৫৯ টাকা নির্ধারণ করেছিল বিইআরসি। আর যানবাহনের জন্য প্রতি লিটারের দাম ৪৭ দশমিক ৯২ টাকা। এ ছাড়া সরকারি খাতের সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ধরা হয় ৫৯১ টাকা। কিন্তু দেশের কোথাও এখন পর্যন্ত এই দামে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে না।
গতকাল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, নরসিংদীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রির খুচরা দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবখানেই বেশি দাম রাখছেন খুচরা বিক্রেতারা। দোকানিরা জানান, বসুন্ধরা, ওমেরা ও টোটাল গ্যাসের ১২ কেজি সিলিন্ডার তারা কিনেছেন ৯৭৫ থেকে এক হাজার টাকায়। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হওয়ায় তাদের পক্ষে বিইআরসির দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়।
রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, মগবাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বেশকিছু এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিইআরসির নির্ধারিত দামে এখনো এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে না। এখনো বসুন্ধরা ১২ কেজির সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০ থেকে ১১শ টাকায়। টোটাল গ্যাস ১১শ টাকায়, ওমেরা ও সেনা ১ হাজার ৫০, জি-গ্যাস, ফ্রেশ ও যমুনা ১ হাজার ৫০, বেক্সিমকো ১ হাজার ৫০ থেকে ১১শ টাকা ও পেট্রোম্যাক্স বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকায়। এ ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির গ্যাস ১ হাজার ৫০ থেকে ১১শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
সরকার নির্ধারিত দামে খুচরা দোকানে গিয়ে এলপিজি না পেয়ে গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার এক গ্রাহক জানান, বেসরকারি কোম্পানির একটি ১২ কেজির এলপিজির সিলিন্ডার তিন দিন আগেও তিনি ১১শ টাকায় কিনেছেন স্থানীয় বাজার থেকে। দোকানদার সাফ জানিয়ে দেন, ১১শ টাকার কমে দিতে পারবেন না। না নিলে তার কিছু করার নেই। দোকানদার তাকে বলেছেন তার বেশি দামে কেনা। বিইআরসি বলেছিল, এলপি গ্যাসের দামবিষয়ক আদেশ বাস্তবায়ন না হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এখন পর্যন্ত তারা কোথাও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তবে সম্প্রতি বিইআরসির আদেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান।
বিইআরসিকে লেখা লোয়াবের চিঠিতে বলা হয়েছে, সিলিন্ডারের দর ঘোষণার সময় অনেকগুলো খাতের খরচ বিবেচনা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে অপারেটর প্রফিট ৮৯ টাকা, ডিস্ট্রিবিউশন খরচ ২৫ টাকা। বিইআরসি নির্ধারিত দামে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার প্রফিট যথাক্রমে ২৪ টাকা ও ২৭ টাকা ধরা হয়েছে, এটি বাস্তবসম্মত হয়নি। সব মিলিয়ে তারা খরচ ৪৮১ টাকা চেয়েছিলেন, সেখানে বিইআরসি ১৯৪ টাকা অনুমোদন করেছে। এলপিজি শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় ১২ কেজি সিলিন্ডারের ঘোষিত দর ৯৭৫ টাকার সঙ্গে আরও ২৮৭ টাকা যুক্ত করার আবেদন জানায় লোয়াব।
এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে লোয়াবকে চিঠি দিয়ে বিইআরসি বলেছে, দাবিকৃত ২৮৭ টাকা যুক্ত করলে ১২ কেজি ওজনের সিলিন্ডারের দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ২৬২ টাকা। এই মূল্য যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হবে না বলে কমিশন মনে করে। কমিশন বলেছে, মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক অনুসৃত নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, দর ঘোষণার আগে মার্কেট যাচাই করে দেখা গেছে ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি সিলিন্ডার ৯৩০ থেকে ৯৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া কমিশন এনবিআরের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিন ধাপের ১৫ শতাংশ মূসক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। নতুন করে মজুদকরণ ও বোতলজাত পর্যায়ে মূসক ৫ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিইআরসি জানিয়েছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম কম। অথচ দর ঘোষণার পর বাড়তি দাম চাওয়াটা বেশ রহস্যজনক। মূসক কমে আসায় নতুন করে বাড়তি সুবিধা পাবেন অপারেটর।
১২ এপ্রিল এলপি গ্যাসের দর ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, সৌদি কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে প্রতিমাসের ভিত্তিমূল্য অর্থাৎ গ্যাসের নিট মূল্য ধরা হয়েছে। ওই দর ওঠানামা করলে প্রতিমাসে দর সমন্বয় করা হবে। সুখবর হচ্ছে, এলপি গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজারদর চলতি এপ্রিলে আরও কমে গেছে। টনপ্রতি প্রায় ৫৫শ টাকা কমে গেছে, এর সুফল ভোক্তারা আগামী মাস থেকে পেতে যাচ্ছেন বলে বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে।