বিদ্যুৎ সংযোগ: আঞ্চলিক মানেও নেই বাংলাদেশ

ব্যবসা শুরু করতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই বিদ্যুৎ–সংযোগের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু আপনি চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ–সংযোগ পাবেন না। এ জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), ডিমান্ড নোট, মাশুলসহ নানা ধরনের কাগজপত্র বিদ্যুৎ অফিসে জমা দিতে হবে। এরপর বিদ্যুৎ অফিসের কর্মীরা পরিদর্শনে আসবেন। তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। এ ছাড়া টেবিলে টেবিলে তো ঘুরতে হবেই। এভাবে ধাপে ধাপে সব কাজ শেষ করে বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে আপনাকে চার মাসের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে।

অবকাঠামো নিয়ে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের এমন দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে গড়ে ১২৫ দিন বা ৪ মাস ৫ দিন সময় লাগে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দুঃসংবাদ হলো, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়, অর্থাৎ ২৮তম স্থানে। বিদ্যুৎ–সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ১৭৯ দিন সময় লাগে কম্বোডিয়ায়। এ ছাড়া আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভানুয়াতুতে ১০০ দিনের বেশি লাগে। সবচেয়ে কম ১৩ দিন লাগে কোরিয়ায়।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে সময় বেশি লাগার দুটি কারণ দেখিয়েছে বিশ্বব্যাংক। কারণদুটি হলো আবেদনের জটিল প্রক্রিয়া ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা। অথচ বাংলাদেশ এখন উদ্বৃত্ত পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। তার মানে, বিদ্যুতের চাহিদা যত, তার চেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের।

জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা এ দেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে প্রথমেই চাইবেন বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে এখন চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। তাহলে সংযোগ পেতে এত সময় লাগবে কেন? চাহিদার চেয়ে উৎপাদনক্ষমতা বেশি হওয়ায় তিন দিনেই বিদ্যুৎ–সংযোগ পাওয়া উচিত। তিনি জানান, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কারখানার মেশিনপত্র নষ্ট হয়ে যায়। জেনারেটর কিনতে হয়। এতে ব্যবসায়ের খরচ বেড়ে যায়।

বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন এবং পানি ও পয়োনিষ্কাশন-এই তিন ধরনের অবকাঠামোব্যবস্থায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মানেও নেই

এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন এবং পানি ও পয়োনিষ্কাশন—এই তিন ধরনের অবকাঠামো পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এই তিন ধরনের অবকাঠামোই দুর্বল। এমনকি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মানদণ্ডেও নেই বাংলাদেশ।

সংস্থাটি বলছে, এই তিন ধরনের অবকাঠামোতে যে দেশ যতটা উন্নত, সে দেশের নাগরিকদের জীবনমানও তত বেশি এগিয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যও সহজ হয়। বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়।

বিদ্যুৎ খাত
বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লস বা কাঠামোগত ক্ষতিও বাংলাদেশে অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তলানির দিকে। এ দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণে সিস্টেম লস হিসেবে ১১ শতাংশই হারিয়ে যায়। অবশ্য বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য সান্ত্বনা হতে পারে আফগানিস্তান, যাদের সিস্টেম লস সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ। সবচেয়ে কম মাত্র ২ শতাংশ সিস্টেম লস সিঙ্গাপুরে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের মূল্য ও পরিচালন খরচের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। মালদ্বীপ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিদ্যুতের দাম ও পরিচালন খরচের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে পল্লি এলাকা বিদ্যুৎ–সুবিধার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে খুব পিছিয়ে। এ দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির আনুপাতিক হারও বেশ কম। এ দেশে বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক বেশি।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৮ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ–সুবিধা পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৯৯ শতাংশ শহর এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। গ্রাম এলাকায় এই হার ৮১ শতাংশের কিছুটা বেশি। ঘণ্টাপ্রতি এক কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম দশমিক ০৮ ডলার। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের মান মাঝামাঝি। এখানে ৭ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৩ দশমিক ৭।

সড়কের মান দুর্বল
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ২৯টি দেশের সড়কের মানের কথা বলা হয়েছে। এতে দেখা যায়, নেপাল ও মঙ্গোলিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের সড়কের মান ভালো নয়। খোদ রাজধানী ঢাকার সড়কে উদ্বেগজনক যানজট হয়। সড়কের মানসংক্রান্ত ৭ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৩ পয়েন্টের কিছু বেশি। সিঙ্গাপুরের সড়কের মান সবচেয়ে ভালো, পেয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ পয়েন্ট। এ ছাড়া ৫ পয়েন্টের বেশি পেয়েছে জাপান, কোরিয়া ও মালয়েশিয়া।

দুর্বল মান ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় তুলনামূলক বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। এখানে প্রতিবছর ১ লাখ লোক মারা গেলে

১৫ জনই মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এই হার এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশ বেশি। সে জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ট্রাফিক আইন সংস্কার করার পরামর্শ দিয়েছে।

পানি সরবরাহে সবচেয়ে পিছিয়ে
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইপের মাধ্যমে নাগরিকদের পানি সরবরাহ করে থাকে প্রায় সব দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ এই সুবিধা পান। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবার শেষে। জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে শতভাগ মানুষ সরবরাহ করা পানি পান।

আবার ঢাকার নাগরিকদের পাকিস্তানের করাচি, শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং এমনকি ব্রুনেই দারুসসালামের মতো ধনী দেশের নাগরিকদের চেয়েও বেশি দামে পানি কিনে খেতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটানেই বাংলাদেশের তুলনায় পানি সরবরাহের খরচ বেশি। এ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশে পানি সরবরাহব্যবস্থা খুবই দুর্বল। শহুরে নাগরিকদের ৩৭ শতাংশ সরবরাহ করা পানিসুবিধা পেলেও গ্রামের মাত্র আড়াই শতাংশ মানুষ এই সুবিধা পান।

অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে
বাংলাদেশে এখন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করা হয়। অথচ যেকোনো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে জিডিপির অন্তত ৬-৭ শতাংশ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। এর কিছু উদাহরণও আছে। যেমন চীন নব্বইয়ের দশকে জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছে। কোরিয়া
তাদের অর্থনৈতিক উত্থানের সময় ৩০ বছর ধরে জিডিপির গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। এমনকি মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশও ৬-৭ শতাংশ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে।

এদিকে ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিবছর ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে ২ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করা উচিত।

এ বিষয়ে আবুল কাশেম খান বলেন, সরকার এখন জিডিপির ২-৩ শতাংশ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের একটি মহাপরিকল্পনা দরকার।
:প্রথম আলো

Scroll to Top