করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। একই সঙ্গে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। এ দুটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য চারটি কৌশল নির্ধারণ করে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আর এবারের বাজেটের শিরোনাম ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’। মানুষের জীবন রক্ষা এবং স্বল্প সম্পদের সঠিক ব্যবহারের জন্য বিলাসী ব্যয় সংকোচনেরও প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য অবাধে কালো (অপ্রদর্শিত) টাকা সাদা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও আগামী বছর উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাপী ভোগ কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয়ই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ জন্য আগামী বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। গতকাল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নতুন অর্থবছরের জন্য এ বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে বিরোধী দল বাজেট অধিবেশনে অংশ নেয়। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া মানুষের আয় কমে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ জন্য চাল, ডাল, তেল, আলু, আটা, পিয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কমানোর ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। একইভাবে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অধিক সংখ্যক সামাজিক সুরক্ষা দিতে আগামী বছর নতুন করে ১১ লাখ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মহামারী কভিড-১৯ মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতেও নানা উদ্যোগের প্রস্তাব করেছেন। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় কৃষি উৎপাদনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য কৃষিখাতে ভর্তুকিসহ সামগ্রিক বরাদ্দও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। অন্যদিকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রে খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংকে টাকা জমা রাখার ক্ষেত্রেও গ্রাহকদের অতিরিক্ত কর দিতে হবে। সব ধরনের তামাক পণ্যের দাম বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের নানাদিকও তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। মূলত সেখানেই তিনি চারটি কৌশলের কথা বলেছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য, বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিতকরণ, অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রবর্তন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি। এ চারটি কৌশল দিয়েই আগামী অর্থবছরজুড়ে দেশের অর্থনীতি সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।
সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য ১০০টি দারিদ্র্যপ্রবণ উপজেলায় সব দরিদ্র প্রবীণ ব্যক্তিদের বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা হবে। এতে তিন লাখ নতুন করে উপকারভোগী হবে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে মুদ্রাবাজারে তারল্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু রাখার স্বার্থে রোপোর সুদহার ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মৃতপ্রায় শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করতে কর সুবিধা দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। দ্বৈত কর পরিহার করা, মুনাফার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অনলাইনে কর দিলে প্রথমবারের মতো ২ হাজার টাকা কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হার ৩৫ শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরির করহার ১২ শতাংশ। এটি ২০২০ সালের জুনে শেষ হবে। বিনিয়োগ ধরে রাখতে তা আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। করোনার প্রভাবে টিকে থাকতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহের জন্য উৎসে কর সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ, যা ভিত্তিমূল্যে ২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত এমএস স্ক্র্যাপ সরবরাহের ওপর আয়কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কথা বিবেচনায় নিয়ে এমএস স্ক্র্যাপ সরবরাহের উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। রসুন ও চিনি আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর রয়েছে তা কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। তৈরি পোশাক খাতে পণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করতে আগাম উৎসে কর রহিত করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। শেয়ারবাজার, বন্ড, জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট, সঞ্চয়পত্র, অ্যাপার্টমেন্টের কালো টাকা সাদা করা যাবে। আন্ডার ইন ভয়েসিং ও ভুয়া বিল প্রমাণিত হলে ৫০ শতাংশ জরিমানার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে টাকা পাচার বন্ধ হবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় ভ্যাট আইনের বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে স্থানীয় শিল্পের অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। রেয়াত সুবিধা ২ করবর্ষ থেকে বাড়িয়ে ৪ করবর্ষ করা হয়েছে। রেয়াত গ্রহণের আওতা বাড়িয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া ও ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মূসক অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ভারী প্রকৌশল, অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনারসহ কতিপয় শিল্পকে বিদ্যমান মূসক ও সম্পূরক শুল্কের অব্যাহতির প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। স্থানীয় পর্যায়ে সরিষা তেলের ওপর মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। করোনা টেস্টের কিট আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পিপিই, সার্জিক্যাল মাস্ক উৎপাদন ও স্থানীয় পর্যায়ের মূসক অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মেডিটেশনের ওপর মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তামাকজাত পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক কর যৌক্তিকীকরণের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। পিয়াজ আমদানিতে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। লবণ আমদানিতে শুল্কহার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মৎস্য ও পোলট্রি শিল্পের রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দুটি উপকরণ যুক্ত করা হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের জন্য শিল্পখাতে শুল্ক আরোপ ও রহিত করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। মধু আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পে কতিপয় পণ্যে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বন্ড সুবিধা যথাযথ ব্যবহার এবং লাইসেন্সিং বিধিমালা যৌক্তিকীকরণ করার প্রস্তাব করেছেন। পাদুকা শিল্পের তিনটি কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ডিটারজেন্ট তৈরির কাঁচামালে শুল্ক কমানো হয়েছে। সোনা আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট ব্যয়ের পরিসংখ্যান : আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার মোট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। চলতি বাজেটে যা ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আবার সংশোধিত বাজেটে সেটি কমিয়ে করা হয় ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটের চেয়ে আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়ছে ৬৬ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আগামী বাজেটে সরকার পরিচালন ব্যয় বাবদ খরচ ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের চেয়ে ৩৭ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা বেশি।
অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হবে ৫৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ৫ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা। সম্পদ সংগ্রহ, ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ, শেয়ার ও ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ ইত্যাদি পরিচালন বাবদ মূলধন ব্যয় হিসেবে ৩৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। খাদ্য হিসাব বাবদ ৫৬৭ কোটি টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে ঋণ ও অগ্রিম (নিট) বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৪ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত নয় এবং নিজস্ব উৎসের রাজস্ব থেকে অর্থায়নকৃত উন্নয়নমূলক কর্মসূচি তথা স্কিম বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এছাড়া এডিপিবহির্ভূত কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা।
টাকা আসবে যেখান থেকে : আগামী অর্থবছরে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩ কোটি টাকা। এছাড়া আগামী অর্থবছরে সরকার বৈদেশিক অনুদান পাবে ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। সব মিলে সরকারের আয় হবে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত করসমূহ থেকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা : আগামী অর্থবছরের অনুদান ব্যতীত বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। তবে অনুদানসহ ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ৮৮ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে প্রস্তাবিত বাজেটে। তবে আগামী অর্থবছরে ১২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে চায় সরকার। তাই এক্ষেত্রে আগামী বাজেটে নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে (সংশোধিত) যা আছে ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতির বড় একটি অংশ পূরণ করতে চায় সরকার। ব্যাংক খাত থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের জন্য সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিতে চায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নিতে চায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
জিডিপি আকার ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি : আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। তবে টাকার অংকে সংশোধিত জিডিপির তুলনায় নতুন জিডিপি ৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা বেশি। চলতি বাজেটে (সংশোধিত) জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, এবারের বাজেটটি গতানুগতিক ধারার কোনো বাজেট নয়। এখানে দেশের মানুষের জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আর অর্থনীতি যাতে আগের ধারায় ফিরতে পারে সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় সরকারের অতীতের অর্জন এবং উ™ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয় তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে সঙ্গতকারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতকে। পাশাপাশি কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কৃষি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যকে পুনরুদ্ধার করাসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বাজেটে বিভিন্ন প্রস্তাবনা করেছে। এছাড়াও দেশের সাধারণ মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিবরণ তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আশার কথা দিয়ে শেষ করেছেন তার বাজেট বক্তৃতা। শেষ লাইনে তিনি বলেছেন, মহামারী করোনাভাইরাস থেকে আমরা আবারও ফিরে যাব স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, উন্মোচিত হবে এক আলোকিত ভোরের। বক্তৃতার এই অংশে তিনি আল কোরআনের সূরা বাকারার-১৫৫ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারী একটি আল্লাহর পরীক্ষা। ‘আমি অবশ্যই তোমাদের কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই; মাঝে মাঝে তোমাদের বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে, তাদের সুখবর দাও।’ (সূরা আল-বাকারা-১৫৫)।
করোনা মহামারীর কারণে সীমিত করা হয় সংসদের বাজেট অধিবেশন। এ জন্য অন্যবারের মতো এবার অধিবেশনে কোনো অতিথি ছিল না। সংসদ সদস্যদেরও উপস্থিতি ছিল সীমিত। গতকাল অর্থমন্ত্রী বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন। টানা ৫২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে সংসদে মন্ত্রিসভাকক্ষে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপর অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর গায়ে ছিল ম্যাজেন্টা রঙের জামদানি শাড়ি আর অর্থমন্ত্রীর গায়ে ছিল কালো প্যান্ট ও নীল শার্টের ওপরে আকাশি নীল কোট। প্রধানমন্ত্রীর হাত ছিল গ্লাভসে মোড়া, দুজনের মুখে ছিল সার্জিক্যাল মাস্ক। করোনাভাইরাস সতর্কতায় অন্যান্য বারের মতো অধিবেশন কক্ষ জমজমাট ছিল না। ছিল না কোনো দেশি-বিদেশি অতিথিও। সীমিত করা হয় বাজেট অধিবেশন।
সম্পূরক বাজেট : চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এছাড়া বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৪ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
:বাংলাদেশ প্রতিদিন