এক লাফে ডাবল সেঞ্চুরির মুখ দেখল পেঁয়াজ। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে। সকালেও কোনো কোনো বাজারে দাম ছিল ১৮০ টাকা। কোনো কোনো খুচরা বাজারে দাম ২২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অস্থির হয়ে উঠে পেঁয়াজের বাজার। ২৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে ভারত। বাংলাদেশ আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপরই নির্ভরশীল। ফলে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়তে থাকে। তখন দুই দিনের মধ্যে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়ায় দেশি পেঁয়াজের দাম। ভারতীয় পেঁয়াজও বিক্রি হতে থাকে ১০০ টাকার কাছাকাছি দরে। অবশ্য বাজার তদারকি ও হুজুগ শেষের পর দাম আবার কিছুটা কমে। তবে গত কয়েক দিন ধরে আবার লাগামহীন হয়ে পড়েছে পেঁয়াজের দাম।
আজ দুপুরে কাওরানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, এক পাল্লা (৫ কেজি) পেঁয়াজ ১০০০ টাকা দর হাঁকছেন বিক্রেতারা। বেশির ভাগ ক্রেতা মলিন মুখে এক কেজি পেঁয়াজ কিনে ফিরে যাচ্ছেন। দাম কেন বেড়েছে জানতে চাইলে, বেশির ভাগ বিক্রেতা জানান, বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ নেই। দেশি পেঁয়াজের মজুতও প্রায় শেষ। তার ওপর ঘূর্ণিঝড়ে পেঁয়াজ পরিবহনে বিঘ্ন ঘটায় বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। তাই দাম বেড়েছে। কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১ কেজি ২০০ টাকা দরে। অপেক্ষাকৃত খারাপ মানের ছোট পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা দরে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে থেকে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে।
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ক্রেতা ফাতেমা জানান, বাড়িতে একটাও পেঁয়াজ নেই। সকালে পেঁয়াজ কিনতে বাসার পাশের দোকানে গিয়ে শোনেন এক কেজি পেঁয়াজ ১৯০ টাকা। পরে এক কেজি পেঁয়াজ কিনে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
খিলগাঁওয়ের আরেক ক্রেতা বলেন, সকালে ১৭০ টাকা দিয়ে এক কেজি পেঁয়াজ কিনেছিলাম। দাম বাড়বে শুনে আবার ওই দোকানে যাই, দোকানি বলে ১ কেজি এখন ১৯০ টাকা। এই হচ্ছে অবস্থা।
রামপুরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ২০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানালেন ক্রেতারা। আমিন রহমান নামে এক ক্রেতা জানান, বেলা ১টার দিকে ২২০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনেছেন তিনি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম গত সপ্তাহেও ছিল ১১৫ থেকে ১২৫ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা।
শ্যামবাজারের আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা আবদুল মাজেদ বলেন, চাহিদার বিপরীতে জোগান একদম কম। দেশি পেঁয়াজ এখনো ওঠেনি। ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি নেই। সব মিলিয়ে অস্থির বাজার।
গত মঙ্গলবার সংসদে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন বলেন, \’শিগগিরই পেঁয়াজের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসবে উপজেলা পর্যায় বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।\’ তিনি বলেন, ‘এখন লিন সিজন (পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হওয়ার আগমুহূর্ত) চলছে। এ সময় একটা সংকট থাকে। আমাদের নতুন পেঁয়াজ এখনো ওঠেনি। কিছুদিনের মধ্যে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভারত থেকেও আমদানি চালু হয়েছে। পেঁয়াজের বাজার যেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলে, সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু আছে, কোথাও কেউ যেন বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে।’ তবে এই আশ্বাসের পরও ঝাঁঝ বেড়েছে পেঁয়াজের দামে।
কেবল রাজধানী নয়, বাইরেও পেঁয়াজের বাজারে আগুন। জামালপুরে প্রতিনিধি জানান, সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত জামালপুর শহরের সকাল বাজার, শফি মিয়ার বাজার, বানিয়া বাজার, বউ বাজার ও বড় বাজারে ঘুরে প্রকার ভেদে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা কেজিতে। তবে ওইসব বাজারের বেশিরভাগ খুচরা দোকানে পেঁয়াজ পাওয়া যায়নি। কিছু দোকানে পেঁয়াজ থাকলেও ক্রেতারা দাম শুনেই অনেকেই চলে যাচ্ছেন।
রোজিনা খাতুন নামের জামালপুরের এক গৃহিণীর ভাষ্য, বাজারের বেশিরভাগ খুচরা দোকানেই পেঁয়াজ নাই। জামালপুর শহরের সকাল বাজার পুরোটাই ঘুরেও পেঁয়াজ কিনতে পারছিলেন না তিনি। অবশেষে সকাল বাজারের খুচরা দোকানদার সাজু মিয়ার কাছ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনেন রোজিনা খাতুন।
রোজিনা খাতুন আক্ষেপ করে বলেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষরা কেমনে কেনে পেঁয়াজ। দেখেন বাজারে ২০০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ নিলাম। ২০০ টাকায় পেঁয়াজ কিনলে অন্য সবজী কিভাবে কিনবো। এক কেজিতে ৫০ থেকে ৬০টি পেঁয়াজ পাওয়া যায়। দেখেন, প্রতি পেঁয়াজ প্রায় তিন টাকা করে দাম পড়ছে। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন কোথাই যাব! আগের চেয়ে রান্নায় পেঁয়াজ কম দিতে হচ্ছে।’
জামালপুর শহরের সবজী বিক্রেতা সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জামালপুর শহরে প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ মণ পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে সরবরাহ কম থাকায় প্রতিদিন মাত্র ২০ থেকে ৩০ মণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ কম থাকায় ক্রেতারা পেঁয়াজ পাচ্ছেন না। অনেক আড়তদার পেঁয়াজ এখন পাইকারি কিনে আনছেন না। পাবনা থেকে ১৭৫ টাকা কেজিতে এখন পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। তারপর পরিবহন খরচ রয়েছে। সব মিলে আমাদের আড়তে এসে পেঁয়াজের কেজি পড়ছে ১৮০ টাকা। তাহলে আমরা কত টাকা দরে বিক্রি করব। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় পেঁয়াজের দাম অনেক বেশি।’
জামালপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াছমিন বলেন, ‘প্রায়ই পেঁয়াজের বাজারে আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হয়ে থাকে। পেঁয়াজের বাজারে কোন সিন্ডিকেট থাকলে, খোঁজখবর নিয়ে ওইসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়াও দ্রুত সময়ের মধ্যেই বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ব্যবস্থা করা হবে।’
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার প্রতিনিধি জানান, আজ সকাল থেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী বাজারে পেঁয়াজের কেজি ১৮০ টাকা। গত বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাটহাজারীর খুচরা ও পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয় ১১০ টাকা দরে। কিন্তু আজ সকাল থেকে ওইসব দোকানে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০ টাকায়। এক লাফে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭০ টাকা।
চট্টগ্রামে মোহাম্মদ রুবেল নামে এক দোকানদার বলেন, গতকাল দোকানে পেঁয়াজ বিক্রি করেছি ১১০ টাকায়। বিকালে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পাইকারি দোকানে পেঁয়াজ কিনতে ফোন করে জানতে পারি দাম বেড়েছে। খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাইকারি দরে কিনতে হয়েছে ১৬০ টাকায়। গাড়ী ভাড়াসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করতে হচ্ছে খুচরা বাজারে ১৮০ টাকা দরে।
রুবেল বলেন, আগে প্রতিদিন দোকানে দুইশ থেকে আড়াইশ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হতো। এখন বিক্রি করছি ২০ থেকে ৩০ কেজি পেঁয়াজ। পাইকাররা তাদের বলছেন বার্মা থেকে পেঁয়াজ আসছেনা তাই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ।
:প্রথম আলো