চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। অনেক দেশের রপ্তানি কমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। দেশটির মুদ্রামানও কমছে। বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর ভারতের অর্থনীতির এই অবস্থা আর হয়নি। তবে এশিয়ার বড়ো বড়ো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলেও সেসব দেশে যে এখনই মন্দা হবে— তা নয়। তবে হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো ছোটো দেশগুলো নিশ্চিতভাবেই ঝুঁকির মুখে আছে।
চীনা পণ্যে নতুন করে আরোপ করা শুল্ক রবিবার থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে এশিয়ার বিনিয়োগকারীদের মাঝে। পুঁজিবাজারেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। বৃহস্পতিবার হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচক পড়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের সাংহাই কম্পোজিট সূচক পড়েছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ, জাপানের নিক্কি সূচক শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোপসি সূচক পড়েছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।
ভারতের প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৫ শতাংশে :ভারতের অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। ইতিমধ্যে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার। এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিক হিসাবে ভারতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। আগের প্রান্তিকেও এই হার ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ৮ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি করা দেশটিকে নিয়ে এখন শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার পেছনে চাহিদার ঘাটতিকেই প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের রুপির দর কমে গেছে। এক মাসের ব্যবধানে রুপি দর হারিয়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রুপির দাম পড়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির গতি শ্লথ থেকে শ্লথতর হয়ে পড়া। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ থেকে অস্থিরতা শুরু হয়েছে মুদ্রাবাজারে। এতে ডলারের বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দরপতন ঘটছে।
বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের অর্থনীতিকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির বেকারত্বের হার ৭.৯ থেকে ৯.১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। চাহিদা কমছে গাড়ির, ভোগ্যপণ্যের। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যেখানে ভারতে ২ লাখ ৯১ হাজার গাড়ি বিক্রি হয়েছিল, সেখানে চলতি বছরের জুলাই মাসে তা নেমে এসেছে ২ লাখ ১ হাজারে। এর ফলে মারুতি-সুজুকি এ সপ্তাহে তিন হাজার অস্থায়ী কর্মী ছাঁটাইয়েরও ঘোষণা দিয়েছে।
ভারতের ২৭ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক একীভূত হচ্ছে ১২টিতে : ইতিমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমাতে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) কাছ থেকে ধার করেছে ১ দশমিক ৭৬ লাখ কোটি রুপি। শুক্রবার ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সংযুক্ত করার কথা জানিয়েছেন। এর ফলে ভারতের ২৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কমে দাঁড়াবে ১২টিতে। ভারতীয় গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটির হাইওয়ের নির্মাণ আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
ভুগবে আরো কিছু দেশ : বিবিসির এক বিশ্লেষণে অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এশিয়া অর্থনীতি বিভাগের প্রধান লুইস কুজিস বলেছেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে এশিয়ার ছোটো দেশগুলো ভুগবে। কারণ চীনের ওপর এশিয়ার অনেক দেশই নির্ভরশীল। মূলত চীনের উত্পাদনের সঙ্গে এসব দেশ নানাভাবে যুক্ত। চীন যে কার্যাদেশ পায়, তার মধ্যে ছোটোখাটো বা শ্রমঘন কাজগুলো তারা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনের মতো দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে চীনের কার্যাদেশ পাওয়া কমে গেলে এই দেশগুলো বিপাকে পড়বে। তবে বাংলাদেশে এখনই মন্দার ধাক্কা লাগবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ বাংলাদেশ বেশি দামি বা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন পণ্য রপ্তানি করে না বলে এখনো অতটা আক্রান্ত হয়নি। তবে বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের রপ্তানিও কমতে পারে।
ইতিবাচক দিক হলো বাংলাদেশের রপ্তানি সাম্প্রতিককালে বেড়েছে। বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন অর্থাত্ ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় চার শতাংশ বেশি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ গার্মেন্টস খাত থেকে এসেছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর। রপ্তানির ৮২ শতাংশই যায় এ দুটি বাজারে। এসব বাজারে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা রপ্তানি তথা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।ইত্তেফাক