এবারের বাজেট হচ্ছে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা

বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বিকেল ৩টায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে চমক নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম ‘স্মার্ট’ বাজেট এটা।

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার থেকে ৫৮ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বা ১৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে সংশোধিত বাজেট কমিয়ে করা হয় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আগামী বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, এবারের বাজেট ‍শুধু এক বছরের জন্য হবে না। এই বাজেটে ২০৪১ সাল পর্যন্ত করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া থাকবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের নতুনত্ব হলো— এটি হবে একটি সহজ বাজেট। যাদের জন্য বাজেট তারা যাতে বাজেটটি সহজেই বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হবে না। বরং করের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানো হবে।

সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর, ব্যাংক, পুঁজিবাজার, সঞ্চয়পত্র ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সংস্কারসহ বেশ কিছু সুপারিশ থাকছে। সেই সঙ্গে থাকছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির ঘোষণা। প্রথমবারের মতো বাজেটে থাকছে শিক্ষিত বেকারদের জন্য ঋণ তহবিল (স্টার্টআপ ফান্ড)। এই তহবিল থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে পারবে বেকাররা। এছাড়াও, কৃষকের জন্য পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে চালু করা হবে শস্যবীমা। প্রাথমিকভাবে একটি জেলাকে শস্যবীমার জন্য বেছে নেয়া হবে। পরবর্তী সময়ে এটি সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে।

করের বোঝা নয় আওতা বাড়ছে: ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে জনগণের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে করের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। সেজন্য নতুন করে ৮০ লাখ করদাতা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হবে। বর্তমানে কর দিচ্ছে দেশে এমন লোকের সংখ্যা ২০ লাখ। ফলে, করের আওতায় এক কোটি লোককে আনা হবে। করের আওতা বাড়াতে সারাদেশে জেলা ও উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৯ লাখ হাট-বাজারের করযোগ্য ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে এর আওতা বাড়ানো হবে। এছাড়া, দেশব্যাপী করযোগ্য হলেও যারা তারা কর দিচ্ছেন না, তাদের শনাক্ত করে করের আওতায় আনা হবে।

প্রবাসীদের বীমার আওতায় আনার উদ্যোগ: এবারের বাজেটে আরেকটি নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সেটি হলো— প্রবাসীদের জন্য বীমা সুবিধা। বর্তমানে বিদেশে প্রায় এক কোটি প্রবাসী রয়েছে। এ ছাড়াও, প্রতিবছর নতুন করে ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ বিদেশে যাচ্ছে। এদের বীমার আওতায় আনা হবে। এসব প্রবাসীরা বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন, নানা ধরনের প্রতারণা শিকার হয়ে দেশে আসছেন। বিভিন্ন ঝুঁকির কারণে তাদের বীমার আওতায় আনা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও আমার গ্রাম আমার শহর: আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী পালনের বিশেষ দিকনির্দেশনা থাকছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী। এরই মধ্যে সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বছরব্যাপী ‘মুজিব বর্ষ’ ঘোষণা করেছে। আগামী ১৭ মার্চের আগে এটি শেষ বাজেট হওয়ায় এই বাজেটে বেশকিছু নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে, যেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী যথাযথভাবে পালন করা যায়।

এছাড়া, আগামী বাজেটে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নামে আরেকটি নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী আগামী বাজেটে গ্রামকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হবে। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের আওতায় গ্রামে ইন্টারনেট, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানা ধরনের নাগরিক সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য আগামী অর্থবছরে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে।

বাড়ছে সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা: আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হচ্ছে। নতুন করে প্রায় ১৩ লাখ গরিব মানুষকে নতুনভাবে এ সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। এতে সুবিধা পাবেন প্রায় ৮৯ লাখ গরিব মানুষ। চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় রয়েছে ৭৬ লাখ মানুষ। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাজেটে ৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন করে বয়স্ক ভাতা পাবেন চার লাখ, বিধবা ভাতা পাবেন তিন লাখ মানুষ, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হবে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে।

অন্যদিকে, দরিদ্র মায়ের মাতৃত্বকালীন ভাতা ৭০ হাজার, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়ের ভাতাভোগী ২৫ হাজার, জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১০ হাজার চা-শ্রমিক এবং অন্যান্য সুবিধাভোগী থাকবে আরো ১৫ হাজার মানুষ।

ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর সীমা ও করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে: বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণীর আয়কর সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থ্যাৎ কোনো ব্যক্তি বছরে এই পরিমাণ অর্থ আয় করলে তাকে কোনো আয়কর দিতে হয় না। গত চার বছর ধরে ব্যক্তি আয়কর সীমা একই আছে। আগামী অর্থবছরেও তা অপরিবর্তিত থাকছে। অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। আগামী অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত করপোরেট কর আড়াই থেকে ৫ শতাংশ কমানোর জন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। তবে, আগামী বাজেটে করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে বলেই জানা গেছে।

বাজেটের আয়-ব্যয়: প্রস্তাবিত বাজেটের চূড়ান্ত আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদানসহ আয় হবে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ শতাংশ। এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আয় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। আর কর বর্হিভূত রাজস্ব আয় ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা।

এদিকে, বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়াও, ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৫৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ৫২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা এবং বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।

বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ: আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ (অনুদানসহ) ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদান বাদে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। মোট ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ ২৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং তা জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকছে। এই ঘাটতি মোকাবিলায় বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ২৭ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এবং অন্যান্য উৎস থেকে নেয়া হবে ৩ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ফলে, আগামী অর্থবছরে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে ৫ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে নেয়া হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি: আগামী বাজেটে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছর ধরা হয় ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কম থাকবে। ফলে, অন্যান্য পণ্যের দাম কিছুটা নিম্নমুখী থাকবে। এদিক বিবেচনায় নতুন বাজেটে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে।

লেটেস্টবিডিনিউজ/এনপিবি

Scroll to Top