বরিশালে খাবার নিয়ে দেড়মাস ধরে ভাসমান অসহায় মানুষের পাশে

প্রাণঘাতী করোনার ফলে দেশে বিরাজ করছে অস্থিতিশীল পরিবেশ। অনেকেই সুস্থ হয়ে ফিরছেন বাড়ি, আবার কেউবা হচ্ছেন মৃত্যু পথযাত্রী।

করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিভাগ ও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। যদিও বিশেষ ব্যবস্থায় সম্প্রতি খেটে-খাওয়া কিছু মানুষ কর্মে ফিরেছেন, তবে করোনায় ছুটি আর লকডাউনের কারনে দীর্ঘসময় ধরে কাজ-কর্ম বন্ধ রয়েছে অনেকেরই। সরকার ও প্রতিষ্ঠানের নানান উদ্যোগের কারণে আবাসস্থল থাকা কর্মহীন অসহায় ও দুস্থ পরিবারগুলো মোটামুটি তাদের দিন পার করলেও ভাসমান মানুষগুলোকে করোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধার সঙ্গেও যুদ্ধ করছে।

তবে এমন বাস্তবতায় করোনা মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে বরিশালের গণমাধ্যমকর্মীসহ মানবিক কিছু মানুষ। যাদের উদ্যোগে প্রায় দেড় মাস ধরে প্রতিদিন রান্না করা খাবার সরবরাহ করছেন বরিশাল নদীবন্দরে থাকা দুইশ ছিন্নমূল শিশু, নারীসহ দুস্থ ব্যক্তিদের জন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের কিছু গণমাধ্যমকর্মীদের হাত ধরে ভাসমান অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগটা শুরু হয় গেলো ২৬ মার্চ থেকে। ওইদিন রাতে নদীবন্দর ও আশপাশের এলাকায় থাকা ভাসমান, অবহেলিত শিশু, নারীসহ অসহায়দের খাবার পরিবেশন করেন তারা। এরপর থেকে প্রতিদিনই রাতে রান্না করা খাবার বিতরণ চলে এসব মানুষের মাঝে।

এরপর ১ এপ্রিল এসব মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ায় বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও বন্দর কর্মকর্তা আজমাল হুদা মিঠু সরকার। তার পক্ষ থেকে শুরু হয় এসব মানুষদের জন্য দুপুরের খাবার সরবরাহ করা। তবে একটানা ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার পরে বন্ধ হয়ে যায়। ২৫ এপ্রিল দুপুরের খাবার সরবরাহ বন্ধ থাকার বিষয়টি রাতে শিশু ও নারীরা গণমাধ্যমকর্মীদের জানায়। তারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পরের দিন ২৬ এপ্রিল থেকে রোজাদার ব্যতিত সবার জন্য দুপুরেও খাবার সরবরাহ শুরু করেন। যদিও এরপরেই মানবিক কিছু মানুষের সদিচ্ছায় দুপুরের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন বরিশালের এসএসসি-১৯৯৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এরপর গত ৩ মে পুনরায় নৌ-বন্দর কর্তৃপক্ষ দুপুরের খাবার সরবরাহে আগ্রহী হন। এর ধারাবাহিকতায় বন্দর কর্মকর্তা আজমল হুদা মিঠু সরকার এসএসসি-১৯৯৩ ব্যাচের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখন দুপুরে একদিন বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং একদিন ৯৩-ব্যাচের শিক্ষার্থীরা খাবার সরবরাহ করে চলেছে। অন্যদিকে গত ২৬ মার্চ থেকে অব্যাহতভাবে রাতে রান্না করা খাবার সরবরাহ করার পাশাপাশি নৌবন্দরে থাকা অসহায় রোজাদার মানুষদের জন্য সেহেরিরও ব্যবস্থা করে চলেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। এসবকিছুর মাঝেই গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের এই কাজের নাম দিয়েছেন ‘উদ্যোগ’।

গণমাধ্যমকর্মীরা জানান, সারা দেশে যখন করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তখন ঢাকা-বরিশালের লঞ্চসহ সব হোটের বন্ধ করে দেয় সরকার। লঞ্চ এবং হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বরিশাল নৌ-বন্দর এলাকায় কাজ করে বেঁচে থাকা ছিন্নমূল শিশু এবং অসহায় মানুষ খাবার সংকটে পড়ে। করোনার ঝুঁকি মোকাবিলায় মানুষদের সচেতন করতে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে সংবাদকর্মীদের। শুরুতে কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন। পরে এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করেন তারা।

লঞ্চঘাটে থাকা অসহায় মানুষের এক বেলা খাবার ব্যবস্থা করার ইচ্ছা থেকেই বরিশালের গণমাধ্যমকর্মীরা কাজ শুরু করেন। প্রথম দুই দিন বরিশাল প্রেসক্লাব সম্পাদক এসএম জাকির হোসেন ব্যক্তিগতভাবে খাবার সরবরাহ করেন। পরে তার সঙ্গে অর্থ ও খাবার সহায়তা নিয়ে এগি আসেন কাজী আফরোজা নামে এক উদ্যোক্তা। এরপরই বরিশালের গণমাধ্যমকর্মীরা লঞ্চঘাটে থাকা সব শিশুদের ধারাবাহিকভাবে রান্না করা খাবার সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাদের এই উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে যুক্ত হয়েছেন, হচ্ছেন বলে জানান সাংবাদিক ফিরোজ মোস্তাফা।

বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক মঈনুল ইসলাম সবুজ জানান, কোনো ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা থেকে নয়, কেবল দুস্থদের পাশে থাকার জন্য গণমাধ্যমকর্মীরা একাট্টা হয়েছেন। সবাই যার যার অবস্থান থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার পাশাপাশি শারীরিক শ্রমও দিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত এই খাবার সরবরাহ অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।

এদিকে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্ধ থাকা দুপুরের খাবার সরবরাহ সমন্বিতভাবে সরবরাহ শুরু করা হয়েছে। যে কাজে বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা কার্যালয়ের সহযোগিতা রয়েছে। পাশাপাশি দুপুরের এই খাবার চালিয়ে যেতে বরিশালের জেলা প্রশাসকও এক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছেন।

Scroll to Top