বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা কেড়ে নিল ডা. প্রিয়াংকার জীবন

সিলেট পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রিয়াংকা তালুকদার শান্তার (২৯) ইচ্ছা ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনে তার সে ইচ্ছার কবর হয়েছে। গত রোববার শ্বশুরবাড়ি সিলেট নগরীর পশ্চিম পাঠানটুলা এলাকার পল্লবী সি ব্লকের ২৫ নাম্বার বাসা থেকে প্রিয়াংকার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

নিহত প্রিয়াংকা তালুকদার শান্তার বাবার বাড়ি সুনামগঞ্জ শহরের পশ্চিম নতুনপাড়া এলাকায়। তার বাবা ঋষিকেশ তালুকদার একজন ব্যাংকার ও মা একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। একমাত্র আদরের মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তার বাবা-মা। নিহত প্রিয়াংকার তিন বছরের শিশু কাব্যকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন তার মা। বলছেন, ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে আমার মেয়েটার এমন অবস্থা হলো। আমার আদরের নাতিটা অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে কী করে থাকবে। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাদের দাবি মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. প্রিয়াংকার স্বামী দিবাকর দেব কল্লোল পেশায় স্থপতি। তিনি লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রিয়াংকা যখন মেডিকেলে পড়াশোনা করতো তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেম। পরিবারও মেনে নিয়েছিল তাদের সম্পর্ক। ধুমধাম করে বিয়ে দেন পরিবারের বড় মেয়ের। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর থেকেই প্রিয়াংকার ওপরে শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। বিভিন্ন রকমের অত্যাচার সহ্য করেছেন তিনি।

প্রিয়াংকা তালুকদার শান্তা পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ছিলেন। এছাড়া তিনি সুনামগঞ্জে সরকারি সতীশ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় সুনামের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। তার স্বপ্নে একধাপ এগিয়ে ছিলেন ডাক্তার হয়ে। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন বিসিএস পরীক্ষা দিতে। প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন আগামী বিসিএস পরীক্ষার অংশগ্রহণের। কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ছয় মাস আগে। এতেই অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ির লোকজন। কোচিংয়ে বাধা দেন স্বামী ও শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। বিষয়টি প্রিয়াংকা পরিবারকে জানালে সুরাহা হয়েছিল। কিন্তু নির্যাতন বন্ধ করেনি শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শেষ পর্যন্ত গত রোববার বিকেলে প্রিয়াংকার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

প্রিয়াংকার সুনামগঞ্জের বাসার প্রতিবেশী স্বপন কুমার রায় বলেন, খুব ভালো ও মেধাবী মেয়ে ছিল প্রিয়াংকা। সে মানুষের সেবা করতেই ডাক্তারি পেশা বেছে নিয়েছিল। কিন্তু এই সমাজের মানুষ তাকে বাঁচতে দিল না। এ ঘটনায় জোরালো তদন্ত সাপেক্ষে তিনি দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন।

প্রিয়াংকার ছোট ভাই পলাশ তালুকদার বলেন, আমার বোন খুব ভালো ছিল। সে সব সময় গরীব মানুষের সেবা করতো। কিন্তু স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর থেকে তার ওপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন নির্যাতন করেছে। আমাকে ফোনে বিষয়টি অনেকবার বলেছে। মৃত্যুর তিনদিন আগে আমার বোন ফোন দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। তার কথায় মনে হচ্ছিল একটা চাপের মধ্যে আছে।

তিনি আরও বলেন, আমার বোন চাইছিল বিসিএস দিতে। সে জন্য সে কোচিং সেন্টারের ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে পড়তে দেয়নি। সে কোচিং ফি জমা জমা দিয়েও পড়তে পারেনি। আমার বোনকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

শান্তার বাবা ঋষিকেশ তালুকদার বলেন, আমার মেয়ে কখনো কারও ক্ষতি করেনি। কেন আমি আমার মেয়েকে হারালাম। সে আমাকে অনেকবার বলেছিল অত্যাচারের কথা। আমি অনেকবার এটা নিয়ে কথা বলেছিলাম ওর স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু শেষমেষ আমি আমার মেয়েকে হারালাম। ওরা বলছে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু আমার মেয়ে আত্মহত্যার করার মতো মেয়ে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।

উল্লেখ্য, গত রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শ্বশুরবাড়ি সিলেট নগরীর পশ্চিম পাঠানটুলা এলাকার পল্লবী সি ব্লকের ২৫ নাম্বার বাসা থেকে প্রিয়াংকার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় দুপুরে তার স্বামী স্থপতি দিবাকর দেব কল্লোল, শ্বশুর সুভাষ চন্দ্র দেব ও শাশুড়ি রত্না রানী দেবকে আটক করে পুলিশ।

প্রিয়াংকার বাবা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানায় তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় সোমবার প্রিয়াংকার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়িকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

Scroll to Top