দুই হাত ও একটি পা নেই তামান্না আক্তার নূরার। আছে একটি মাত্র পা। সেই পা দিয়ে লিখেই এসএসসি’তে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। একটি মাত্র পা নিয়েই সংগ্রাম করে আসা মেয়েটি এ বছর যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া জে. কে. মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।
তামান্না নূরার বাবা যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউপির আলিপুর গ্রামের রওশন আলী ও মাতা খাদিজা পারভিন শিল্পী।
তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, তামান্না জিপিএ-৫ পেয়েছে। তবে বাংলায় এ গ্রেড হওয়ায় তামান্নার মন একটু খারাপ। তারপরও সার্বিক ফলাফলে আমরা খুশি। একটি পা নিয়ে মেয়েটি সংগ্রাম করে এতদূর এসেছে। তবে মেয়ের ফলাফলে খুশি হলেও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই বাবা রওশন আলীর মনে। কারণ মেয়ের স্বপ্নপূরণ করতে হলে তাকে কলেজে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে তেমন ভালো কলেজ বা লেখাপড়ার সুযোগ কম। মেয়েটিকে একটি ভালো কলেজে দিতে গেলে সেখানে রাখতে হবে। কিন্তু যেহেতু তার দুটি হাত একটি পা নেই, তাই তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাউকে না কাউকে থাকতে হবে। ফলে কীভাবে মেয়ের লেখাপড়া করাবো বুঝতে পারছি না। তবে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও মেয়ের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তামান্নার পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে খাদিজা পারভিন শিল্পী একটি কন্যা শিশুর জন্ম দেন। যার দুটি হাত ও একটি পা নেই। সেই সন্তান তামান্না নূরাকে বুকে চেপে বাড়ি ফেরেন বাবা-মা। সামাজিক অনেক প্রতিকূলতাও মোকাবেলা করতে হয় তাদের।
অভাবের সংসার। তারপরও বেড়ে উঠা শিশুটির চাহনি, মেধা মা শিল্পীর মনে সাহস যোগান দিয়েছিল। মায়ের কাছে প্রথমে অক্ষর জ্ঞান নিতে থাকে তামান্না। বাসা থেকে দূরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা সহজ ছিল না। বাসা সংলগ্ন শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজমাইন এডাস স্কুলে তাকে নার্সারিতে ভর্তি করা হয়। মা স্কুলের ক্লাসে বাচ্চাকে বসিয়ে দিয়ে ক্লাসের বাইরে অবস্থান করতেন। তার শ্রবণশক্তি ও মুখস্থ শক্তি এতো ভালছিল যে একবার শুনলে বিষয় আয়ত্ব ও মুখস্থ বলতে পারত।
এরপর অক্ষর লেখা শুরু করে পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে চক ধরে। তারপর কলম দিয়ে লেখার আয়ত্ব করে সে। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, আঙ্গুলের ফাকে চিরুনি, চামচ দিয়ে খাওয়া, চুল আঁচড়ানো সহজেই আয়ত্ব করে তামান্না।
ধীরে ধীরে নিজের ব্যবহারিত হুইল চেয়ারটি এক পা দিয়ে চালানোর দক্ষতা অর্জন করে সে। নিজ বিদ্যালয়ে কেজি, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির ফলাফলে মেধা তালিকার পাশাপাশি এডাস বৃত্তি পরীক্ষায় প্রতিবার সে বৃত্তি পেয়েছে। লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে আজমাইন এডাস স্কুল থেকে পি.ই.সি ও ২০১৬ সালে বাঁকড়া জে.কে. মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জে.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। চলতি বছর সে বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজে কেন্দ্রে এস.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
তামান্নার বাবা রওশন আলী জানান, তিনি ঝিকরগাছার পোয়ালিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার শিক্ষক। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠান এখনও এমপিওভুক্ত হয়নি। ফলে প্রাইভেট পড়িয়ে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে সংসার চলে। এ অবস্থায়ও মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছেন তিনি।
তিনি উল্লেখ করেন, মেয়ের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু তাকে বুঝিয়েছি, তুমি শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ নও। মেডিকেল পড়তে গেলে ব্যবহারিক অনেক কাজ থাকে। তাই মেয়েটি এখন লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। জানি না মেয়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো কীনা!’