লাইন, কোচ এবং সংকেতব্যবস্থা—সবই ঠিক আছে। এরপরও চালু হচ্ছে না রাজধানীর জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রোরেল। নিচের দিকের কর্মীদের চেয়ে বড় কর্তারা বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন—এমন অভিযোগ এনে কর্মবিরতিতে মেট্রোরেলের কর্মচারীরা। এ জন্যই কারিগরি কোনো সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এ জটিলতা নিরসন করে কবে নাগাদ মেট্রোরেল রেল চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত নয়। কর্মচারীরা লিখিতভাবে দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অনড়।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, কোম্পানিতে যত লোকবল রয়েছে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই প্রশাসন ক্যাডারের। সরকারের বিভিন্ন প্রকৌশল দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তারাও চুক্তিতে নিয়োজিত আছেন। কোম্পানির কর্মকর্তার সংখ্যা ৫০–এর কাছাকাছি। আর বিভিন্ন প্রকল্পে আরও কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। এর মধ্যে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর পর্যন্ত সড়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। অবসরে যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর চুক্তিতে তিনি মেট্রোরেলের এমডি নিযুক্ত হন। এখনো তিনি এই দায়িত্বে আছেন।
অন্যদিকে মেট্রোরেল চালানো, টিকিট বিক্রি, রক্ষণাবেক্ষণসহ সব দায়িত্ব নিচের দিকের স্থায়ী কর্মীদের। তাঁরা ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারী। তাঁদের সংখ্যা সাত শতাধিক। ৮ আগস্ট থেকে তাঁরা বৈষম্য দূর করার ছয় দফা দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করছেন। ২০১৯ সাল থেকে এই কর্মচারী নিয়োগ শুরু হয়। নিয়োগ এখনো চলমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডিএমটিসিএল শতভাগ সরকার মালিকানাধীন কোম্পানি। চুক্তিভিত্তিক ও বাইরে থেকে আসা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মূল বেতনের ২ দশমিক ৩ গুণ বেতন পান। আর ডিএমটিসিএলের ১০ থেকে ২০তম গ্রেডের স্থায়ী কর্মীরা পান দুই গুণ। এটা একটা বড় অভিযোগ নিচের দিকের স্থায়ী কর্মীদের। এ ছাড়া কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডও (প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল) চালু হয়নি তাঁদের।
একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়োগের পর থেকেই তাঁরা দাবিগুলো করে আসছেন। কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়েছে বহুবার। কিন্তু কার্যকর হয়নি। এবারও মৌখিকভাবে দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তবে তাঁরা এতে রাজি নন। কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন।
নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১১ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ১৭ আগস্ট থেকে মেট্রোরেল চালু হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল স্বাভাবিক নিয়মে চলাচল করবে। তবে মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে আপাতত ট্রেন থামবে না। কারণ, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় এ দুটি স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ডিএমটিসিএল সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত শনিবার থেকে মেট্রোরেল চালু সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান। এতে বলা হয়, অনিবার্য কারণে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি।
তবে ডিএমটিসিএলের সূত্র জানায়, নিচের দিকের কর্মচারীদের কর্মবিরতির কারণেই মেট্রোরেল চালু করা যায়নি। কর্মবিরতিতে যাওয়ার পর কর্মচারীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়। এর মধ্যে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর সঙ্গেও বৈঠক হয় কর্মবিরতিতে থাকা কর্মচারীদের। তাঁদের জানানো হয় যে দাবিদাওয়া পূরণ করতে হলে ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পরিষদের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু এখন পরিষদের অনেক সদস্যই নেই।
ডিএমটিসিএল পরিচালনায় ১০ সদস্যের পরিষদ রয়েছে। এর চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব। ১৪ আগস্ট চুক্তিতে থাকা সচিব আমিন উল্লাহ নুরীর চুক্তি বাতিল করে সরকার। সদস্য হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী নিলুফার আহমেদ (রাজনৈতিক নিয়োগ) নেই। অন্য সদস্যরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। ফলে নতুন করে পর্ষদ গঠন না করলে দাবিদাওয়া পূরণ করা যাবে না।
ডিএমটিসিএলের এমডি এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, কর্মচারীদের যৌক্তিক সব দাবি তাঁরা মেনে নেবেন। এ বিষয়ে নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছে। তবে কর্মচারীরা ডিএমটিসিএলের পর্ষদে পাস করার পর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করতে চান। আগামীকাল (রোববার) সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসা উপদেষ্টাকে বিষয়টি অবহিত করার চেষ্টা করবেন। আশা করছেন, একটা নির্দেশনা পাবেন।
গত বৃহস্পতিবার চারজন উপদেষ্টা শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যে ফাওজুল কবির খান সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
কর্মচারীদের দাবি
বর্তমান বেতনকাঠামো পরিবর্তন করে ‘বৈষম্যহীন’ বেতনকাঠামো, অর্থাৎ সব গ্রেডের একই রকম বেতনকাঠামো যা জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ এর ২ দশমিক ৩ গুণ হারে যোগদানের তারিখ থেকে বকেয়াসহ দিতে হবে। এ ছাড়া চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে বকেয়াসহ সিপিএফ সুবিধা দিতে হবে।
দাবির মধ্যে আরও রয়েছে রাষ্ট্রের অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মেট্রোরেলের সঙ্গে সমন্বয় করে ১০ম গ্রেডের উচ্চতর পদ, ১৫তম ও ১৬তম গ্রেডের পদসমূহের গ্রেড উন্নয়ন করে ‘অর্গানোগ্রাম’ গঠন করতে হবে। শিক্ষানবিশকাল শেষে অন্যান্য সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির মতো যোগদানের তারিখ থেকে স্থায়ীকরণ (নিয়মিতকরণ) করতে হবে। মেট্রোরেলের স্টেশন, ডিপোসহ সব স্থানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করে দায়িত্ব দিতে হবে।
এর বাইরে রয়েছে কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘স্বৈরাচারী’ মনোভাব ও ‘বৈষম্যমূলক’ আচরণ এবং ব্যক্তিগত আক্রোশের যেন না ঘটতে পারে—সেই নিশ্চয়তা প্রদান ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ডিএমটিসিএলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্মচারীদের দাবি যৌক্তিক। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থের দিকটাই বেশি দেখেছে। সরকারের পটপরিবর্তনের ফলে কর্মচারীরা বিগড়ে গেছেন। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যাঁদের চার-পাঁচ বছর হয়ে গেছে, তাঁদের চাকরির শুরু থেকে সিপিএফ সুবিধা দেওয়াও এখন জটিল।