রাজধানীর ডেঙ্গুর হটস্পট জুরাইন-কদমতলী

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১৬ জনের মৃত্যু
প্রতীকী ছবি

ভয়াবহভাবে সারা দেশে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত কয়েকদিনে ছাড়িয়ে গেছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর আগের রেকর্ড। ডেঙ্গ আক্রান্ত রোগীর চাপ সামাল দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর চাপ বাড়ায় হাসপাতালগুলোতে সংকট বাড়তে শুরু করেছে। শয্যা না পেয়ে অনেকেই মেঝেতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রাজধানীর জুরাইন-কদমতলী এলাকায় সব থেকে বেশি। জুরাইনের কমিশনার রোড, মিষ্টির দোকান, বিড়ি ফ্যাক্টরি, আলমবাগ, মুরাদপুর, ঋষিপাড়া, নামা শ্যামপুর, শনির আখড়া, ধোলাইরপাড় ও দনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশু।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এই দুটি এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্দেশে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এই বিশেষ অভিযান চলবে।

জুরাইন ও কদমতলীর স্থানীয় হাসপাতাল ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। দিন দিন বাড়ছে এর সংখ্যা। বিশেষ করে গত ১৫ দিন আগে থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যত রোগী সুস্থ হচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন তার চেয়েও অনেক বেশি। স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু রোগী। কেউ কেউ বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে বেশিরভাগই চিকিৎসা নিচ্ছেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব এলাকার বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকা, খোলা ড্রেনগুলো (নালা) নিয়মিত পরিষ্কার না করা, উন্মুক্ত খাল ও সিটি কর্পোরেশনের এডিস মশা নিধন ও এর লার্ভা ধ্বংসে কার্যকরী ব্যবস্থা না নেয়ায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

জুরাইন আদ-দ্বীন হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, নারী-পুরুষ ও শিশুসহ গত ১২ জুলাই পর্যন্ত ৪৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আর গত ১ জুলাই থেকে ১০ বছর বয়সী ও তার নিচে ১২৫ জন শিশু ও ৮৪ জন নারী-পুরুষ অর্থাৎ ২০৯ জন এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রতিদিনই কিছু রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন এবং ভর্তি হতে আসছেন তার চেয়ে বেশি রোগী। হাসপাতালে শয্যা পরিপূর্ণ হওয়ায় অতিরিক্ত শয্যার ব্যবস্থা করেছেন কর্তৃপক্ষ।

জুরাইন বিড়ি ফ্যাক্টরি এলাকার দোকান কর্মচারী নুরে আলম তিন দিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখানে ভর্তি আছেন। দনিয়ার ৩৫ বছর বয়সের গৃহিণী আনোয়ারা বেগম চারদিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

তার স্বামী হাবিব দেওয়ান জানান, কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রীর শরীরে জ্বর, প্রচণ্ড ব্যাথা, বমি বমি ও দুর্বলতা ভাব অনুভব করে। পরীক্ষা করে দেখি ডেঙ্গু হয়েছে। প্রথমে কয়েকদিন বাসায় চিকিৎসা করাই। কিন্তু রক্তের প্লাটিলেট ১৮ হাজারে নেমে যাওয়ায় দ্রুত তাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসি।

জুরাইন মুরাদপুর জিরো পয়েন্ট এলাকার আড়াই বছরের শিশু তাসরীফের বাবা তানভীর জানান, গত শুক্রবার শিশুটি জ্বরে আক্রান্ত হয়। ওষুধ খাওয়ার দুই দিন পর জ্বর কমে যায়। কিন্তু তার শরীরের দুর্বলতা বেড়ে যায়। সন্দেহ হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই। পরীক্ষায় ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়ে। পরে হাসপাতালে ভর্তি করাই।

এ বিষয়ে আদ-দ্বীন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। তখন মশাগুলো কাউকে কামড় দিলেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। রোগীর লক্ষণ বুঝে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়া হয়। এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। ডেঙ্গুর জন্য জ্বর হয় ও রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। প্লাটিলেট নিয়ন্ত্রণে রাখাই হলো একমাত্র চিকিৎসা। তবে ডেঙ্গু একটি মৌসুমী রোগ। এটা আগে থেকে নিয়ন্ত্রণ করলে এ রোগীর সংখ্যা অনেক কমে যাবে। তবে আমাদেরও সচেতন হওয়া উচিত।

জুরাইনের সাউথ ইস্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রওশন বলেন, আমাদের এখানে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন জ্বরের রোগী আসেন ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। তবে আমাদের এখানে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা দেয়া হয় না।

দনিয়া দেশবাংলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ডেঙ্গু রোগীর চাপ। এই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সুমন বলেন, দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই কিছু রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও তার চেয়ে বেশি রোগী এসে ভর্তি হন। এখানে প্রতিদিন জ্বর নিয়ে প্রায় দেড়শ রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে আসেন।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কদমতলীর কিছু এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। অনেকেই সুস্থ হয়েছেন, অনেকেই আবার ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। জুরাইন ঋষি পাড়ার মুদি দোকানদার আকরাম, চার বছরের শিশু আলবিভা, ছয় মাসের শিশু লাবিবা ও তিন বছরের শিশু মো. নুরসহ অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এলাকার বাসিন্দা শামসুল আলম জানান, এই এলাকায় অনেক ডেঙ্গু রোগী। বলতে গেলে এটা ডেঙ্গু রোগীর রেড জোন। আলমবাগের বাসিন্দা জুয়েল জানান, আমাদের এখানে এমনিতেই সারা বছর পানি থাকে। আর বৃষ্টি হলে পুরো এলাকা তলিয়ে যায়। দীর্ঘদিন এই পানি জমে থাকে। তাই এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। জুরাইন মেডিকেল রোডের বাসিন্দা রাসেল বলেন, সারা বছর এই এলাকার অনেক রাস্তায় পানি জমে থাকে, রয়েছে খোলা ড্রেন। সিটি কর্পোরেশন থেকে ড্রেনগুলোতে ওষুধ দিতেও দেখা যায়নি।

ডেঙ্গু রোগীর বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. রুহুল আমিন বলেন, আমার ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। এলাকাবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত মসজিদে ও মাইকে মানুষকে সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের যা যা করা দরকার তা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ও এডিস মশা নিধনে জুরাইন এলাকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছি। মেয়র মহোদয় অফিসে এসেই প্রথম জিজ্ঞাসা করেন, জুরাইন-যাত্রাবাড়ী কি অবস্থা, কি করলেন? তার নির্দেশে এই এলাকায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাস থেকে ঈদুল আজহা পর্যন্ত গত ৩ মাসে আমরা ১৬টি ক্রাশ প্রোগ্রাম করেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘোষিত ডিএসসিসির ২৮টিসহ ৩০ ওয়ার্ডে গত ৪-৬ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিন এবং ৯-১১ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিন চিরুনি অভিযান চালিয়েছি। এডিশ মশা নিধন ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত আগামী ৩ মাস এই বিশেষ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তবে এ বিষয়ে এলাকাবাসীকেও সচেতন হতে হবে।

এদিকে শুক্রবার নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪৪৯ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৫১ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৪৭ ও ঢাকার বাইরে নতুন রোগী ১০৪ জন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এছাড়া সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ২২০ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ২ হাজার ৭৫৫ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ৪৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ৮৩১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ৯৪১ জন। আর ঢাকার বাইরে ৫ হাজার ৮৯০ জন।