‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলরে…’
এই সময়ে শিকল পরা হাতে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে ধরা এক টগবগে যুবক মহিউদ্দিন রনি গানটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একলা চলার মাধ্যমেও যে জাতিকে জাগিয়ে তোলা যায়, ভাবিয়ে তোলা যায় মহিউদ্দিন রনিই সে কাজটি করে দেখিয়েছেন। যেখানে তরুণদের নিয়ে নানান হতাশার গল্প সেখানে সে এখন নতুন স্বপ্ন সারথি, তারুণ্যের আদর্শ। বরিশালের এক গাঁয়ের সাধারণ ছেলে আজকের অসাধারণ রনি হয়ে ওঠার গল্পটাও সাদামাঠা।
সবুজ শ্যামল গাঁয়ে বেড়ে ওঠা রনি বরিশাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাটিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। তার বাবা মো. সেলিম হাওলাদার দীর্ঘ জীবন দেশের বাইরে কাটিয়েছেন। বর্তমানে তিনি পারিবারিক বিষয়াদি দেখাশোনার পাশাপাশি কৃষিকাজ করছেন। মা রেনু বেগম গৃহিণী ও উদ্যোক্তা। দুই ভাইবোনের মধ্যে রনি বড়। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। অরাজনৈতিক বাবা-মা নিজেদের কাজের ফাঁকে নানান স্বেচ্ছাসেবায় জড়িত। সেখান থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে ১৩ বছর ধরে রনিও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করছেন। এই দীর্ঘ সময় সে রোভার স্কাউটে, ন্যাশনাল চিলড্রেন টাস্কফোর্সে, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে কাজ করেছেন। রিপোর্টার হিসেবে ‘হ্যালো.বিডিনিউজ২৪.কম’ ও ‘ইউ-রিপোর্ট গ্লোবাল’-এও কাজ করেছেন। এভাবে ধীরে ধীরে রনি শিখেছেন আর নিজেকে গড়েছেন। বর্তমানে ব্রিটিশ কাউন্সিলের একজন ট্রেনার হিসেবে আছেন, যেখানে অ্যাক্টিভ সিটিজেনশিপ ট্রেনিং করান তিনি। এ ছাড়া ‘ইউথ এন্ডিং হাঙ্গার বাংলাদেশে’ ঢাকা জেলা কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ‘বিডি-ক্লীন’ বরিশালের জোনের সক্রিয় সদস্য রনি।
পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন নিজের সৃজনশীলতায় টর্চলাইট ফাউন্ডেশন, ফেসবুকভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম আর্টিস্ট ফর চেঞ্জ। যার সদস্য ১০ হাজারের অধিক। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইতিবাচক ও অসাধারণ ভাবনা নিয়ে রনি বিভিন্ন কাজ করেছেন। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে ‘গ্রিন হ্যাপি বার্থডে ক্যাম্পেইন’, আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে ‘জাতীয় বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতা’, নারীদের জন্য ‘মেকাপ আওয়ার পাওয়ার ক্যাম্পেইন’ উল্লেখযোগ্য। চমৎকার এসব কাজের স্বীকৃতিও মিলেছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিল কর্তৃক করোনাকালীন টপ টেন প্রজেক্ট আইডিয়া নির্বাচনে ‘মেকাপ আওয়ার পাওয়ার’ সেরা আইডিয়ার একটি নির্বাচিত হয়। বন্ধুদের মধ্যমণি এই তরুণ নিজকে শুধু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। নানান সময়ে অন্যায় ও অবিচারের মুখোমুখি হলে সেটার প্রতিবাদও করেন। নাগরিক অধিকার সুরক্ষা ও শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়েও কাজ করেন।
একবার অ্যাক্সিডেন্ট করে ঢাবির মেডিক্যালে ভর্তি হন। সেখানে নানান সমস্যা ও অপর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবায় ক্ষুব্ধ হয়ে অনশন করে বসেন মেডিক্যাল সেন্টারেই। সর্বশেষ রেলের টিকিট কাটতে গিয়ে যখন প্রতারিত হন নিজে একাই নেমে পড়েন ছয় দফা দাবি নিয়ে। রনি বলেন, পুরো দেশ যখন ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত আমি তখন জন অধিকারের প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায়। শুরুতে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছিল না, অনেকে করছিল হাসাহাসি।’ তবে সেসবে না দমে গান গেয়ে, শিকল পরে অভিনব পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে যান তিনি। রনি বলেন, আমার কাজ দেখে অনেকে আমাকে পাগলও বলেছে। রেলওয়ে থেকে বেরও করে দেওয়া হয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর সবাই জেনেছে আন্দোলনের কথা। তখন অনেকে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।’ হুমকি-ধমকি, এ-দ্বার ও-দ্বার ঘুরেছেন। বিদেশ চলে যেতেও পরামর্শ পেয়েছেন রনি। তবে এসব রনিরা সেসবে কান না দিয়ে নিজের ও নাগরিকদের অধিকারের জন্য লড়ে যান। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, নির্ভীক সাহসিকতা জাতিকে মুগ্ধ করে এক দাবিতে একত্রিত করেছে। এরই মধ্যে তার কিছু সাফল্য এসেছে। একজন রনি পুরো জাতিকে জেতার পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। আগামীর তারুণ্য তার দেখানো পথে নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখছে। রনিরাই আনবে নতুন ভোর।