বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গোটা দেশে চলছে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন। সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়লেও স্বাস্থ্যবিধি মানছে না বেশির ভাগ মানুষ।
স্বাস্থ্যবিধি না মানায় করোনার সংক্রমণে ঝুঁকিও বাড়ছে। বিশেষ করে রাজধানীর পুরান ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোতে এখনও গাদাগাদি করে বেচা-কেনা করতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি এমন যে, সেখানে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীও তেমন একটা ব্যবহার করতে দেখা যায়নি বাজারগুলোতে।
এদিকে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারকে। প্রশাসনের নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা না হলে ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দেশে করোনা আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আজ শনিবার (১৭ এপ্রিল) সরেজমিনে ঢাকার সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, রায়সাহেব বাজার, দয়াগঞ্জ, নয়াবাজার, ধূপখোলা মাঠের কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, সবজি, মাছ, মুদি, ফল বিক্রেতাসহ অধিকাংশ দোকানদারই মাস্ক ছাড়া পণ্য বিক্রি করছেন। একইসঙ্গে মাস্ক ছাড়াই কেনাকাটা করছেন ক্রেতারা। মানছেন না নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব। পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্রেতা ও বিক্রেতাকে মাস্ক ছাড়াই বেচা কেনা করতে দেখা গেছে। অনেকের মাস্ক থাকলেও ব্যবহারে উদাসীন। ক্রেতাদের কারো কারো মুখে মাস্ক থাকলেও বিক্রেতাদের বেশির ভাগের মুখে মাস্ক নেই। অনেকে আবার মুখে মাস্ক পরলেও সেটি আবার কারো কারো ঝুলছে থুঁতনিতে। এছাড়া বাজারে ছোট ছোট চায়ের দোকানে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখেই এসব চলতে দেখা গেছে। তবে অপচনশীল দ্রব্য যেমন, চাল, ডাল, তেলের বাজারে তেমন ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগুলো মানুষ কয়েকদিন আগে থেকেই কিনছেন। এজন্য তেমন ভিড় নেই।
নয়াবাজারে বাজার করতে আসা সুমন পোদ্দার বলেন, আজকে বাজারে একটু ভিড় কম। তবে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে৷ ভিড় কম থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মানছে না অনেকেই। অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছেন না, আবার দোকানগুলো নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় থাকছে না। এছাড়া বাজারে কারো কোনো তদারকি নেই। এ কারণে মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা সবকিছুর দাম বাড়ি দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের উচিত দ্রুত বাজার তদারকিতে নামা। তা না হলে কষ্টে থাকা মানুষগুলোর কষ্ট আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এই মহামারির মধ্যেও ব্যবসায়ীরা অনৈতিক কাজ করছে।
সবজির দামের বিষয়ে রায়সাহেব বাজারের ব্যবসায়ী আল আমিন ব্যাপারী বলেন, সবজির দাম এমনিতেই বাড়ছিল। রোজার কারণে দাম আরও বেড়েছে। সবাই ভাবে আমরা সবজির দাম বেশি রাখছি। আড়তে গেলেই টের পাবেন সবজির দাম কি হারে বেড়েছে। আমরা অল্প লাভেই সবজি বিক্রি করেছি। আড়তে দাম বাড়লে তো আমাদের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে সূত্রাপুর বাজারের মেসার্স বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক মো. রিপন বলেন, কাজের সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মানানো অনেক কঠিন। নিজে সচেতন না হলে এটা সম্ভব না। মানুষকে বলেও স্বাস্থ্যবিধি মানানো যায় না। কার আগে কে সদাই নেবে সে প্রতিযোগিতায় সবকিছু ভুলে যায়। যদিও বলা হয় দূরত্ব বজায় রাখতে কিন্তু এতে কোনো লাভ হয় না। আর দূরত্ব বজায় রাখতে হলে দীর্ঘলাইন পড়ে যায়। তখন পাশের দোকানদারের সমস্যা হয়। জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।
এদিকে রাজধানীর বাজারগুলোতে বেগুনের কেজি একশ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে অন্যান্য সবজি। শসা, ঢেঁড়স, বরবটির কেজি একশ টাকার কাছাকাছি। সব ধরনের সবজি চড়া দামে বিক্রি হলেও সপ্তাহের ব্যবধানে কিছুটা কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়, গাজর ৩০ থেকে ৪০ টাকা, শিম ৩০ থেকে ৪০ টাকা, করলা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, মূলা ৪০ টাকা, ঢেঁড়শ ৫০ থেকে ৬০ টাকা, টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা। এছাড়া প্রতি পিস লাউ আকারভেদে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ২০ থেকে ৩০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, কচুর লতি ৬০ টাকা, সাজনা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, আলু বিক্রি হচ্ছে ২০/২২ টাকা কেজি। প্রতি কেজি কাঁচা কলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। পেঁপে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা। ক্ষিরাই ৬০ টাকা, শসা ৫০ টাকা মটরশুটি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। লেবুর দাম বেড়ে হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। শুকনা মরিচ ২০০ টাকা, রসুনের কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকা, আদা ১০০ থেকে ১১০ টাকা। হলুদ ১৮০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা, মিনিকেট ৬৫ টাকা, নাজির ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, স্বর্ণা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, পোলাও চাল ৯০ থেকে ১০০ টাকা। খোলা ভোজ্যতেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৩৯ টাকা। এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকায়। হাঁসের ডিমের দাম কমে ডজন এখন ১৩৫ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা।
প্রতি কেজিতে ২০ টাকা দাম কমে বিক্রি হচ্ছে সোনালি (কক) মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। লেয়ার মুরগি কেজি ২১০ থেকে ২২০ টাকা। এসব বাজারে অপরিবর্তীত আছে গরু ও খাসির মাংস, মসলাসহ অন্যান্য পণ্যের দাম। বাজারে প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, বকরির মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা, গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়।
এসব বাজারে প্রতি কেজি রুই মাছের দাম বেড়ে (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায়, মাগুর মাছ ৬০০ টাকা, প্রতি এক কেজি শিং মাছ (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে চাষ ও দেশি ৪৫০ থেকে ১০০০ টাকায়, মৃগেল ১১০ থেকে ১৫০ টাকা, পাঙাস ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, ইলিশ প্রতি কেজি (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ১ হাজার টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, বোয়ালমাছ প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, কাতল ১৭০ থেকে ২৮০ টাকা, ফোলি মাছ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, পোয়া মাছ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, পাবদা মাছ ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, টেংরা মাছ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, টাটকিনি মাছ ১০০ টাকা, তেলাপিয়া ১৪০ টাকা, সিলভার কাপ ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, কৈ দেশি মাছ ১৫০ থেকে ৭০০ টাকা, কাঁচকি ও মলা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, আইড় মাছ ৫০০, রিডা মাছ ২২০ টাকা ও কোরাল ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, বাইলা ১২০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরকারের ১৪ এপ্রিল ভোর থেকে ২১ এপ্রিল মধ্য রাত পর্যন্ত লকডাউনের ঘোষণার পর থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি বেড়েছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে মজুদ করছে। এজন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিত্যপণ্য না কেনার আহ্বান জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, এ বছর নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকার কারণে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম বাড়িয়েছে টিসিবি। রমজানে যেসব পণ্যের বেশি চাহিদা থাকে, সেগুলোর ১০ থেকে ১২ শতাংশ টিসিবির মজুত রয়েছে। রমজান উপলক্ষে সংস্থাটি সাশ্রয়ী মূল্যে ২৬ হাজার ৫০০ টন ভোজ্যতেল, ১৮ হাজার টন চিনি, ১২ হাজার টন মসুর ডাল, ৮ হাজার টন ছোলা, ৬ হাজার টন পেঁয়াজ বিক্রি করবে। এছাড়া রমজান উপলক্ষে ট্রাকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৫০০টি করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে পণ্য বিক্রি করবে ১০০ ট্রাক।
এসব পণ্য ১ এপ্রিল থেকে ই-কমার্সের মাধ্যমেও বিক্রি করবে সংস্থাটি। কেউ ট্রাক থেকে না কিনলে ই-কমার্স অথবা সরাসরি বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমেও এসব পণ্য কিনতে পারবেন।