হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মাদ মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে নারীসহ আটক হয়েছিলেন। পরে দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। তিনি তার সঙ্গে থাকা নারীকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল শনিবার রাতের ঘটনাটি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। সে কারণে নিজের ফেসবুক পেজে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন মুহাম্মাদ মামুনুল হক। তিনি বিষয়টি নিয়ে দেশের মানুষকে কোনো বিভ্রান্তি এবং ভিন্ন কোনো বক্তব্য না দেওয়ারও আহবান জানান।
গতকালকের এই ঘটনাটি নিয়ে আজ রোববার সকাল ৮টার দিকে হেফাজত নেতা মুহাম্মাদ মামুনুল হক নিজের ফেসবুক আইডিতে ‘একটি মানবিক বিয়ের গল্প’ শিরোনামে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছেন।
পাঠকদের জন্য মামুনুল হকের লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
একটি মানবিক বিয়ের গল্প
\”হাফেজ শহিদুল ইসলাম আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন। সাংগঠনিক কাজে আমার দু-চারজন সহযোগীর অন্যতম। বেশ পুরোনো আমাদের সম্পর্ক। সম্পর্কের গভীরতা পারিবারিক পরিধি পর্যন্ত। পরিবারসহ একে অপরের বাসায় যাতায়াত আমাদের দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রে তার পারিবারিক অভিভাবকত্ব করতাম আমি। পারিবারিকভাবে খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শের জন্য তারা আমার দ্বারস্থ হত। দুই সন্তানের ছোট সংসার নিয়ে চলছিল তাদের জীবন। একটা পর্যায়ে এসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য। মনোমালিন্য থেকে বাদানুবাদ এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু।
আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। তখন তাদের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি। তাদের উভয়ের সাথে কথা বলি। কিন্তু কোনোভাবেই আর সেটি সম্ভব হয়নি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। ছাড়াছাড়ির পর দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন হাফেজ শহীদুল ইসলাম। সেই বিবাহ আমি পড়াই। তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করছেন। সেই ঘরে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে আরেকটি সন্তান। অপরদিকে হাফেজ শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে যায় অনেকটা অসহায়। এক রকমের কূলকিনারাহীন। রাগের মাথায় সংসার ভেঙে গভীর সংকটে পড়ে যান তিনি। ওই পরিস্থিতিতে তার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আমার শরণাপন্ন হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নেন। আর সেই দুঃসময়ে সহযোগিতা করার মতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না তার।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ এবং অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে আমি তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করি। জীবনের করণীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনার জন্য নিয়মিতই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। এমতাবস্থায় একজন বেগানা নারীর সাথে এভাবে সম্পর্ক রাখাকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়।
তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই, যত দিন তার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হবে আমার, তাকে বেগানা হিসেবে রেখে অভিভাবকত্ব করব না, বরং ইসলামী শরীয়তের আলোকে বৈধ একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিব। বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্টজনদের সাথে কথা বলি এবং এ বিষয়ে তাদেরকে জানিয়ে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের কালেমা পড়ে বিবাহ করে নেই। দুবছর যাবত এভাবেই মানবিক ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমি তার অভিভাবকত্ব করছি এবং একজন অসহায় নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করে একটি পুণ্যের কাজ করেছি বলে বিশ্বাস করি।
আমি যা বললাম, এটা আল্লাহর নামের হাজার বার শপথ করে বলতে পারব। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কুল্লামার শপথও করতে পারি। বিষয়টি খোলাসা করার পরেও যুবলীগ আওয়ামী লীগের গুন্ডারা আমার সাথে যে অমানবিক আচরণ করেছে এবং হামলা করেছে, গায়ে হাত তুলেছে, আমি এর বিচার চাই আল্লাহর কাছে, প্রশাসনের কাছে এবং জনগণের কাছে। পুলিশের উপস্থিতিতে তাদের এই হামলা ও আচরণ প্রমাণ করে বর্তমানে বাংলাদেশে মান-সম্মান কিংবা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করা সম্ভব না।\”
ইতিপূর্বে গতকাল রাতে তিনি ফেসবুক লাইভে এসেও বিয়ে ও ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন। মুহাম্মাদ মামুনুল হক বলেন, \”এই মুহূর্তে সারা দেশে একটা বিষয় নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে, আমাদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয়েছে দেশব্যাপী। সেই ঘটনার প্রকৃত বিবরণ তুলে ধরতে আমি ফেসবুক লাইভে এসেছি। পারিবারিকভাবে মিডিয়ার সামনে যে বক্তব্যটি তুলে ধরার জন্য আমরা এখানে এসেছি, আশা করছি আমাদের এ বক্তব্যের পরে বিষয়টি নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি এবং ভিন্ন কোনো বক্তব্য আর কেউ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।\”
\”বিশ্রামের জন্য ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ের একটি সুন্দর দর্শনীয় স্থান সোনাগাঁও জাদুঘরে গিয়েছিলাম। সেখানে সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিলেন। স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে কিছুটা ধোয়াশা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি আমার বিবাহিত দ্বিতীয় স্ত্রী। তার সাক্ষী নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি করার চেষ্টা করা হয়েছে। ওখানে উপস্থিত পুলিশের কর্মকর্তা জনাব মোশারফ সাহেব আমার কাছ থেকে যাবতীয় বিষয় শুনে এবং তার তথ্যপ্রমাণ যাচাই করে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।\”
যিনি আমার সাথে ছিলেন তিনি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু, আমার সহকর্মীর সাবেক ওয়াইফ ছিলেন। তার সাথে তার আড়াই বছর ধরে কলহের জের ধরে… তার দুটি সন্তান রয়েছে। তো সেই সূত্র থেকে আমি একান্ত পারিবারিকভাবে আমার ঘনিষ্ট কিছু বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে বিবাহ বন্ধনের ব্যবস্থা করি। সেই বিবাহের মাধ্যমেই তিনি আমার বিবাহিতা শরীয়তসম্মত বিবি (স্ত্রী)।
আমার এ বক্তব্যে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু সেখানে স্থানীয় সেই সংবাদকর্মীদের সাথে উপস্থিত ছিল স্থানীয় কিছু যুবলীগ এবং সরকার দলীয় কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মী। (তারা) আমার সঙ্গে অসদাচারণ করেছেন। এ ছাড়া লাইভ ভিডিও ধারণ করে নেতারা সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা এবং আক্রমণ চালিয়েছেন।
এ বিষয়গুলো যখন তারা লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করেছেন, তখন দেশবাসী জেনেছে। তখন আমার সেখানকার বক্তব্য দেশের মানুষ শুনেছে। পারিবারিকভাবে স্ত্রীসহ পরিচয়টা স্পষ্টভাবে তুলে ধরার পর সেটা ভাইরাল হয়ে গেছে সারা দেশে। স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতি টের পেয়ে… সেখানে আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য তারা উপস্থিত হয়। কাজেই আমি আহ্বান করব, এই বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিমূলক কোনো কথা যেন কেউ প্রচার না করে।\”
তার আগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধারের পর উপজেলার মোগরাপাড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে তার অনুসারীরা। শনিবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে হেফাজতের কর্মীরা জড়ো হয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে আধাঘণ্টা বিক্ষোভ করে চলে যান। এ সময় মহাসড়কে যান দেড় ঘণ্টা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মামুনুল হক সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর কক্ষে এক নারীকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রিসোর্টের নিচে অবস্থান নেন। সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) গোলাম মোস্তাফা বিষয়টি জানতে পেরে, থানার উপপরিদর্শক (তদন্ত) তবিদুর রহমানসহ একদল পুলিশ স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে রিসোর্টের পঞ্চম তলায় মামুনুল হকের কক্ষের সামনে যায়। মামুনুল হকের কক্ষের ভেতরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা প্রবেশ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মামুনুল হকের কক্ষে প্রবেশ করার পর ওই নারী বাথরুমে প্রবেশ করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় পুলিশের সামনে মামুনুল হক গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আমার সঙ্গে অবস্থান করছিলেন আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আমেনা তৈয়বা।’
পরে ওই কক্ষে প্রবেশ করেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোশারফ হোসেন। তিনি মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় খবর পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক ও হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীরা রয়েল রিসোর্টের ফটকের বাইরে অবস্থান নেয়। ‘মামুনুল হকের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, এ ধরনের নানা স্লোগান দেন মামুনুল হকের অনুসারীরা। হেফাজত নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা রিসোর্টের দ্বিতীয় ফটক দিয়ে চলে যান।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে হেফাজত কর্মীরা স্থানীয় বিভিন্ন সড়ক দিয়ে লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা রির্সোটের ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে রিসোর্টের নিচ তলাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর শুরু করেন। পরে পুলিশ মামুনুল হককে রিসোর্টের অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে আসে।
ওই সময় হেফাজত কর্মীরা মামুনুল হককে পুলিশের কাছ থেকে ‘ছিনিয়ে’ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতে করতে স্থানীয় মোগরাপাড়া চৌরাস্তার পাশে হাবিবপুর ঈদগাহ ও মসজিদে নিয়ে যান। ঈদগাহে মাঠে মামুনুল হক হেফাজত কর্মীদের সামনে বক্তব্য দেন।
সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, মামুনুল হক ওই নারীকে দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করায় এবং ওই নারী মামুনুল হককে স্বামী দাবি করায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ভাঙচুরের সঙ্গে যারা জড়িত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।