হাজারীবাগে মায়ের পরিকল্পনায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বাবার গলা কাটে ছেলে

রাজধানীর হাজারীবাগে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মা শিল্পী বেগমের নির্দেশে কলেজপড়ুয়া ছেলে মিজান মাহমুদ ছয়টি ঘুমের ওষুধ কিনে আনেন। এরপর শিল্পী ঘুমের ওষুধ শরবতের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে দেন তাঁর স্বামী মো. সোহেলকে। শরবত খাওয়ার পর সোহেল ঘুমিয়ে পড়লে শিল্পী মিজানকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। মিজান বন্ধু ফাহিমকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের ভাড়া বাসায় চলে আসেন। মাকে ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে চলে যেতে বলে মিজান ফাহিমকে নিয়ে হত্যা মিশনে নেমে পড়েন। মাত্র এক মিনিটের মধ্যে হত্যাকাণ্ড শেষ করে দুজন দরজায় তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যান। তিন দিন পর ওই বাসা থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ গিয়ে দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে।

মা ও ছেলের পরিকল্পনায় বাবা খুনের এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগের মধ্য বছিলার ৬৫/১ নম্বর বাড়ির নিচতলায়। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ ওই বাসা থেকে সোহেলের একটি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করে। পুলিশ তদন্ত করে দেখতে পায়, এনআইডিটি জাল। পরে লাশের ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার থেকে তাঁর নাম পরিচয় নিশ্চিত হয়। এনআইডিতে তাঁর নাম মো. সোহেল। বাবার নাম মমতাজ উদ্দিন হাওলাদার। মায়ের নাম বক্ষুল বেগম। স্ত্রীর নাম হেলেন আক্তার। বর্তমান ঠিকানা নারায়ণগঞ্জ সদরের কাশিপুর।

হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর পুলিশ আদাবরের নবোদয় হাউজিংয়ের একটি বাসা থেকে শিল্পী বেগমকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সাভার থেকে তাঁর ছেলে মিজান মাহমুদ ও ছেলের বন্ধু ফাহিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই তিনজনই হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা জানিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

পুলিশের ধানমণ্ডি জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফী বলেন, জবানবন্দিতে শিল্পী বেগম জানিয়েছেন, সোহেল তাঁর তৃতীয় স্বামী। আর মিজান তাঁর দ্বিতীয় স্বামী সেকেন্দার শেখ সাগরের সন্তান। বছর সাতেক আগে একটি ঘটনায় তাঁর স্বামী সেকেন্দার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি হন। ওই ঘটনায় তাঁর স্বামীকে জামিন করার জন্য তিনি সোহেলের সহযোগিতা নেন। সেখান থেকে সোহেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সোহেল তখন রায়েরবাজারে সবজির দোকানদার বলে পরিচয় দেন। পাঁচ বছর আগে দ্বিতীয় স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে সোহেলকে বিয়ে করেন শিল্পী। বিয়ের সময় মিজান সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী জামিন পেয়ে বাগেরহাটে চলে যান। শিল্পী বছিলা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে সোহেল ও ছেলে মিজানকে নিয়ে থাকতেন। বিয়ের পর তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী একজন প্রতারক।

মানুষের কাছে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য বলে পরিচয় দিতেন। এই পরিচয় দিয়ে তিনি বিভিন্ন মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা নিতেন। এভাবে প্রতারণা করে ছয়-সাত মাস পর পর বাসা পরিবর্তন করে থাকতেন তাঁরা। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ছেলে মিজানের চাকরি দেবেন বলে সোহেল তাঁকে জানান। এ জন্য তিনি বাগেরহাটে তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে আসেন। ওই টাকা সোহেলের হাতে তুলে দেন ছেলের চাকরির জন্য। এরই মধ্যে তিনি জানতে পারেন যে সোহেলের এর আগে তিনটি বিয়ে ছিল। দুই মাস আগে তাঁর দূরসম্পর্কের খালাতো বোনকে সোহেল বিয়ে করেন। এটার প্রতিবাদ করলে সোহেল তাঁর ছেলের সামনে মারধর করেন। এরপর থেকে তিনি তাঁর ছেলের চাকরির জন্য দেওয়া এক লাখ টাকা ফেরত চান। এটা নিয়ে সোহেল প্রায়ই মারধর করতেন।

আদালতে দেওয়া মিজানের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, সোহেল প্রায়ই তাঁর মায়ের ওপর নির্যাতন চালাতেন। গত ১০ সেপ্টেম্বর মা ও ছেলে মিলে সোহেলকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিজান মিরপুরের ফুটপাতের একটি দোকান থেকে গিয়ারওয়ালা চাকু কেনেন। পাড়ার একটি ওষুধের দোকান থেকে ছয়টি ঘুমের ওষুধ কিনে মাকে দেন। ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে তাঁর মা ঘুমের ওষুধ শরবতের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে বাবাকে খেতে দেন। ওই সময় মিজান তাঁর বন্ধু ফাহিমকে নিয়ে বাইরে অবস্থান করছিলেন। বাবা ঘুমিয়ে পড়ার খবর পেয়ে ওই বাসায় তাঁরা যান। মিজান তাঁর মাকে বাসা থেকে তাঁর খালার বাসায় পাঠিয়ে দেন। এরপর মিজান ও ফাহিম মিলে সোহেলকে হত্যা করে পালিয়ে যান।

পুলিশের ধানমণ্ডি জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার আব্দুল্লাহ হিল কাফী আরো বলেন, সোহেল সম্পর্কে তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, তিনি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সময় লোকজনকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিতেন।

Scroll to Top