মহামারী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষ। বন্ধ সব অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ। আয় হারিয়ে খাবি খাচ্ছে মানুষ। এ অবস্থায় রাজধানী ঢাকায় যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকেন তাঁদের বাড়িভাড়া মওকুফের দাবি উঠেছে। ভাড়াটিয়া পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন এই দাবি তুললেও এ নিয়ে সরকার বা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি। বাড়ির মালিকদের বিভিন্ন ধরনের কর ও সার্ভিস চার্জ মওকুফের মতো কোনো সিদ্ধান্তও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র, একাধিক ভাড়াটিয়া, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও কোনো সমাধান মেলেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিক দুই পক্ষেরই গ্রহণযোগ্য যুক্তি রয়েছে। করোনার এই মহামারির সময়ে বেশির ভাগ ভাড়াটিয়ার কোনো আয়-রোজগার নেই। অনেককে ত্রাণের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাড়িভাড়া পরিশোধ করা তাঁদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অন্যদিকে এমন অনেক বাড়িওয়ালা আছেন যাঁদের আয়ের একমাত্র উৎস বাড়িভাড়া। অনেক বাড়িওয়ালার কাঁধে আছে বাড়ি নির্মাণের সময় নেওয়া ঋণের বোঝা।
ব্যতিক্রমী ঘটনাও রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য ভাড়াটিয়াদের ওপর অমানবিক চাপ প্রয়োগ করেছেন এবং এখনো করছেন। এরই মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ে বেশ কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটে গেছে। ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। আবার বেশ কিছু বাড়ি মালিক মানবিক আচরণ করছেন। কেউ কেউ মওকুফ করেছেন। অনেকে বলেছেন, পরে দিলেও চলবে।
মিরপুরের রূপনগর এলাকার ৩০/ক সড়কের ১/১ নম্বর বাড়িতে ভাড়া থাকেন এস এম ইমন নামের এক ব্যক্তি। বাড়ির মালিক খোকন বসবাস করেন অন্যত্র অভিজাত এলাকায়। বাড়ির ভাড়া আদায় করেন কেয়ারটেকার। ভাড়াটিয়া ইমন বলেন, ‘অন্য সময়ে ভাড়া দেরিতে দিলেও কিছু বলেননি; তবে এবার বাড়ির কেয়ারটেকার নোটিশ দিয়ে গেছেন ১ তারিখের মধ্যে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। কেয়ারটেকার পরদিন এসে জানান, বাড়িভাড়া আদায় করতে না পারলে তার বেতন বন্ধ।’
পুরান ঢাকার জে এন সাহা সড়কের ৭/২ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন মামুনুর রশিদ। গত মাসের ভাড়া দিতে পারেননি। বাড়ির মালিক ভাড়ার জন্য চাপাচাপি করছেন। ভাড়াটিয়ার স্ত্রী মুক্তা বলেন, ‘আমরা বাড়ির মালিককে অনুরোধ করে বলেছি, গত মাসের বেতন পাইনি ভাড়া দেব কিভাবে?’ মালিক বলেছেন, এই ভাড়ার টাকায় আমার সংসার চলে। তাই ভাড়া দিতেই হবে। নইলে বাসা ছেড়ে দিন।’
বাড়িভাড়া পরিশোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছে বস্তিবাসী। এই দুর্যোগেও বস্তির ঘরভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে এসবের নিয়ন্ত্রক প্রভাবশালীরা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো এমনিতেই কাজ হারিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে আছে। ঠিকমতো ত্রাণও মিলছে না। তার ওপর ঘরভাড়া নিয়ে চাপে তারা দিশাহারা।
মোহাম্মাদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকার ৬ নম্বর সড়কে একটি বস্তি রয়েছে। এলাকার কিছু মাস্তান ওই বস্তির ভাড়া আদায় করে। বস্তির একাধিক বাসিন্দা জানান, তাঁদের বলা হয়েছে ভাড়া না দিলে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। মধ্যবয়সী রিকশাচালক এক বস্তিবাসীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘এমনিতেই ভাড়া দিতে পারছি না; আবার পত্রিকায় নাম উঠলে কালই আমার হাত-পা ভেঙে তাড়িয়ে দেবে। কেউ ঠেকাতে আসবে না।’
ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য মতে ঢাকায় বসবাসকারী আড়াই কোটি মানুষের মধ্যে বাড়ির মালিক ১০ ভাগ। বাকি ৯০ ভাগই ভাড়াটিয়া। তাদের মধ্যে ৭০ ভাগ ভাড়াটিয়া মধ্যবিত্ত। সে হিসাবে ঢাকা শহরে মোট ভাড়াটিয়ার সংখ্যা দুই কোটি ২৫ লাখ। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ভাড়াটিয়ার সংখ্যা এক কোটি ৭৫ লাখ। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শ্রেণির ভাড়াটিয়ারাই বেশি সংকটে আছেন। আমরা ভাড়াটিয়া পরিষদের পক্ষ থেকে করোনাকালে বাড়িভাড়ার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মওকুফের আবেদন জানিয়েছি। আশুলিয়ার বাড়ির মালিকরা এরই মধ্যে বাড়িভাড়া অর্ধেক নিয়েছেন।’
মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের কালশী সড়কের বাড়ির মালিক ইউসুফ হোসেন তুহিন বলেন, ‘ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়ির মালিকই বাড়িভাড়ার টাকায় তাঁদের সংসার চালান। আবার বাড়ি নির্মাণকালে নেওয়া ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে হয়। তার পরও আমরা মানবিক কারণে বাড়িভাড়া মওকুফ বা অর্ধেক নিতে রাজি আছি। সে ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংকঋণের কিস্তি, ইউটিলিটি বিল ও সিটি করপোরেশনের পাওনাদির বিষয়ে সহানুভূতিশীল হলে বাড়িওয়ালাদের পক্ষেও মানবিক হওয়া সহজ হবে।’
মিরপুর সেনপাড়া এলাকার বাড়ির মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চাকরি জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি করেছি। বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার চলে। ভাড়া না পেলে আমি চলব কিভাবে।’
ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িভাড়া মওকুফের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি খুবই জটিল ও গভীর। ভাড়াটিয়ারা কঠিন সমস্যায় রয়েছে। আবার অনেক বাড়িওয়ালাকেও চলতে হয় বাড়িভাড়ার টাকায়। তাই সব দিক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
:কালের কণ্ঠ