রাজধানীতে ডেঙ্গুর পর এবার ‘গোদ’ এর ভয়

নগরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেছে। তবে কমেনি মশার উপদ্রব। নগরবাসী মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। লোকজন বলছেন, মশকনিধন কার্যক্রমে ঢিলেমির কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, এখন নগরে মূলত কিউলেক্স মশার উপদ্রব চলছে। স্ত্রী কিউলেক্স মশার মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ফাইলেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। ‘গোদ’ নামে পরিচিত এই রোগের কারণে হাত-পা ফুলে যায়। বারবার জ্বর হয়। গোদ রোগ বা ফাইলেরিয়াসিস (Filariasis) এক প্রকার পরজীবী ঘটিত রোগ। এটি ক্রান্তীয় অঞ্চলের সংক্রামক রোগ যা সূতার মতো একজাতের (ফাইলেরিওয়ডিয়া Filarioidea পরিবারভুক্ত নিমাটোড) গোলকৃমি দ্বারা সংঘটিত হয়।

গোদ রোগের লক্ষণঃ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যাওয়া, চামড়া ও এর নিচের টিসু মোটা হয়ে যাওয়া -এগুলোই প্রধান লক্ষন যা মশার কামড় দ্বারা সংক্রমিত রোগ হিসেবে প্রথম চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ফুলে যাওয়াকে এলিফেনটায়াসিস বলা হয়। যখন পরজীবী কৃমিগুলো মানুষের লসিকা তন্ত্রে (lymphatic system) বাসা বাঁধে তখনই এলিফেনটায়াসিস হয়।ফুলে যাওয়াটা পায়েই বেশি হয়। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন জাতের ফাইলেরিয়া-কৃমি ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গে বাসা বাঁধে। Wuchereria bancrofti নামের প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রধানতঃ ফুলে ওঠে পা, বাহু, নারী-যৌনাঙ্গ, স্তন, অন্ডকোষ ইত্যাদি। Brugia timori নামক প্রজাতির ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গ আক্রান্ত হয় কমই।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর সময় যেভাবে মশকনিধন কার্যক্রম চালানো হয়েছিল, এখন তা আর নেই। তাই কিউলেক্স মশা বেড়েছে। তবে নতুন করে দুর্যোগ এড়াতে হলে মশকনিধন কার্যক্রমে ঢিলেমি দেওয়া যাবে না। কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখনই জোর দিতে হবে। মশকনিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল বেশি। এই সময়ে দুই সিটি করপোরেশন বড় আকারে মশকনিধন কর্মসূচি পরিচালনা করে। নগরের বাসিন্দারা বলছেন, সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এ কার্যক্রমে ঢিলেঢালা ভাব দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে মশার উপদ্রব বেড়েছে। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছেন, কিউলেক্স মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

গত দুই দিনে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, লালবাগ, সূত্রাপুরসহ অন্তত আটটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সপ্তাহ ধরে মশার প্রকোপ ব্যাপক বেড়েছে।

নগরে এখন মূলত কিউলেক্স মশার উপদ্রব চলছে। স্ত্রী কিউলেক্স মশার মাধ্যমে গোদ রোগ হতে পারে। মিরপুর ১১ নম্বরের ডি ব্লকের বাসিন্দা গোলাম রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার পর কয়েল জ্বালিয়েও মশা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর অভিযোগ, গত ১৫ দিনে তাঁর বাসার সামনে মশার ওষুধ ছেটাতে তিনি দেখেননি। একই অভিযোগ মোহাম্মদপুরের আল্লাহ করিম জামে মসজিদের পাশের একটি ভবনের বাসিন্দা হযরত আলীর। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর জোরেশোরে মশকনিধন কার্যক্রম চলেছে। তবে এখন এর অর্ধেক পরিমাণ কাজও হচ্ছে না।

চানখাঁরপুলের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, গোদ রোগ খুবই ভয়ংকর। তিনি তাঁর সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, মশার উপদ্রব আগের চেয়ে বেড়েছে। ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতাকর্মী যাঁরা আছেন, তাঁরা নিয়মিত নালা পরিষ্কার করে না। পরিষ্কার না করতে করতে অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফও জানালেন, মশার প্রকোপ একটু বেড়েছে।

কিউলেক্স মশার উপদ্রব সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযানের অংশ হিসেবে প্রতিদিন পাঁচটি করে ওয়ার্ডে জরিপ করা হচ্ছে। জরিপকারী কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, কোন কোন এলাকায় কিউলেক্স মশার প্রকোপ বেশি, তা কীটতত্ত্ববিদের মাধ্যমে জরিপ করে চিহ্নিত করেছেন। যেসব এলাকায় কিউলেক্স মশা তুলনামূলক বেশি, সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণত শীতকালে কিউলেক্স মশার প্রকোপ বাড়ে। তাই পুরোপুরি শীত পড়ার আগেই যেকোনো মূল্যে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন।

Scroll to Top