বিচারের আশায় দুই মাস ধরে মেয়ের লাশ পাহারা

কলেজ ছাত্রী সোমা বালাকে (১৬) হত্যা করা হয়েছে, অথবা তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে- এমন অভিযোগ তুলেছেন নিহত সোমার বাবা দিলীপ বালা। প্রকৃত সত্য উদঘাটনের জন্য তিনি লাশ দাহ না করে কফিনে পুরে মাটিচাপা দিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে পাহারা দিচ্ছেন এই অসহায় বাবা।

ঘটনাটি ঘটেছে মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামে। এ ব্যাপারে দিলীপ বালা বাদী হয়ে মাদারীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন।

স্থানীয়, দিলীপ বালার অভিযোগ ও মামলার বিবরণ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২০ বছর আগে রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের সুতারকান্দি গ্রামের সুনীল বালার ছেলে দিলীপ বালার সঙ্গে বিয়ে হয় একই উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের মনোরঞ্জণ শিকারীর মেয়ে শোভা রাণী বালার। বিয়ের কয়েক বছর পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ বাঁধে। বনিবনা না হওয়ায় শোভা রাণী তাদের শিশুকন্যা সোমা বালাকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। মাঝে মধ্যে তিনি স্বামীর বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। এদিকে, শিশু সোমা বালা মামার বাড়িতে থেকে বড় হয়ে ওঠে এবং লেখাপড়া করতে থাকে।

এসএসসি পাস করার পর সোমাকে গোপালগঞ্জ জেলার কলিগ্রাম বঙ্গরত্ন ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করা হয়। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর তার মামার বাড়ির লোকজন তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

দিলীপ বালার স্ত্রী শোভা রাণী বালা, শাশুড়ি পারুল শিকারী, শ্যালক কৃষ্ণ শিকারীসহ ওই বাড়ির লোকজন সোমার অমতে তাকে পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার বনগ্রামের খোকন মণ্ডলের ছেলে দীপক মণ্ডল (৪৫) নামের এক মধ্যবয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন। সোমা বাল্যবিয়ে করবেনা এবং আরও পড়াশুনা করবে বলে জানায়। একপর্যায়ে তাকে জোর করে বিয়ের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এতে বাধা দেওয়ায় তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করা হয়।

মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন ২৪ জুন সকালে সোমা বালা তার প্রতিবেশী বন্ধু অনিক মোহন্তের বাড়িতে বেড়াতে যান। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে সোমা তার মামার বাড়িতে ফিরে আসেন। এতে সোমার মামার বাড়ির লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। একপর্যায়ে মামা কৃষ্ণ শিকারী সোমার শরীরে শুকনো মরিচের গুড়া মাখিয়ে শারীরিক নির্যাতন করেন। এ অপমান সহ্য করতে না পেরে সোমা আত্মহত্যা করে অথবা তাকে হত্যা করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

এ ব্যাপারে মৃত সোমা বালার বাবা দিলীপ বালা বলেন, “সোমা মারা গেছে। তার লাশ রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়েছে। এ সংবাদ পেয়ে আমি দ্রুত রাজৈর হাসপাতালে যাই। আমাকে দেখে আসামিরা লাশ হাসপাতালের বারান্দায় রেখে পালিয়ে যায়। পরে ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশের কাছ থেকে লাশ বুঝে নেই। কিন্তু শুরুতেই আমার সন্দেহ হওয়ায় এবং সত্য ঘটনা উদঘাটনের জন্য লাশ দাহ না করে কাঠের বাক্সের কফিনে সংরক্ষণ করে বাড়ির পাশেই মাটিচাপা দিয়ে রাখি। কারণ লাশ পুড়িয়ে ফেললে আর কোনও আশা থাকবে না। তাই আমি পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য প্রায় দুই মাস ধরে মেয়ে সোমা বালার লাশ পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। ”

সোমার বাবা দিলীপ বালা আরো বলেন, “আমার মেয়ে সোমাকে হত্যা করা হয়েছে, নাকি নির্যাতন করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে- আমি এ সত্যটা জানতে চাই। এই সত্য জেনে তবেই আমি আমার মেয়ের লাশের সৎকার করব। আমি লাশের পুনরায় ময়নাতদন্ত চাই এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার চাই। ”

মামলা সূত্রে আরও জানা যায়, এ ঘটনায় নিহত সোমা বালার বাবা দিলীপ বালা বাদী হয়ে তার শ্যালক কৃষ্ণ শিকারী ও মোকতেস শিকারী, শাশুড়ি পারুল শিকারী, গুরু মণ্ডল, সুকুমার ঘরামী, শিখা ঘরামী, দীপক মণ্ডল, শুকলাল বৈরাগী, গোপাল বারিকদারের নাম উল্লেখসহ আরও ৩-৪ জনকে অজ্ঞাতনামা করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালতে মামলা করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৃত সোমা বালার এক আত্মীয় বলেন, “সোমার মৃত্যুর পর তার এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। সে ভালোভাবে পাসও করেছে। তার ইচ্ছা ছিল আরও পড়াশুনা করবে। কিন্তু তার মামার বাড়ির লোকজন জোর করে তাকে বাল্য বিয়ে দেয়। জোর করে বিয়ের রেজিস্ট্রি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। এতে সোমা প্রতিবাদ করলে তাকে তার মামার বাড়ির লোকজন প্রচণ্ড মারধর করে। অপমানজনক কথা বলে। এসব ঘটনার পরই আমরা সোমার মৃত্যু খবর জানতে পারি। তাই আমরা এর সঠিক ও সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাই। যদি তাকে হত্যা করা হয়, তাহলে হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানাই। আর যদি তাকে এই অল্প বয়সে আত্মাহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাহলেও সেই অপরাধের জন্য অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাই। ”

মামলার আইনজীবী মো. রেজাউল করিম বলেন, “সোমাকে হত্যা করা হয়েছে, নাকি নির্যাতন করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে- এ সত্যটা উদঘাটন হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য মেয়ের বাবা হিন্দু প্রথা অনুযায়ী লাশ সৎকার না করে কাঠের বাক্সে সংরক্ষণ করে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছেন। পুনরায় লাশের ময়নাতদন্ত করা হলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি। ”

মৃত সোমা বালার নানি পারুল শিকারী বলেন, “সোমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কেন আত্মহত্যা করেছে- আমরা তা জানি না। ”

রাজৈর থানার ওসি মো. জিয়াউল মোর্শেদ বলেন, “সোমা মারা যাওয়ার ব্যাপারে আমরা তদন্ত করে ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী আত্মহত্যা বলেই প্রমাণ পেয়েছি। তবে শুনেছি সোমার বাবা দিলীপ বালা লাশ পুনরায় ময়নাতদন্ত করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে মামলার এক নম্বর আসামি কৃষ্ণ শিকারীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। ” এদিকে, নিহতের মা শোভা রাণী বালাও এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৯ ঘণ্টা, ২৩ আগস্ট, ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/পিকে