শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে চাকরিস্থল শেরপুর থেকে বগুড়া গিয়েছিলেন জাকিয়া সুলতানা রুপা। ২৭ বছর বয়সী এই তরুণী পরীক্ষা দিয়ে ওই দিন বিকালে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহগামী নিরাপদ পরিবহনের ‘ছোয়া’ নামের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৩৯৬৩) একটি বাসে ওঠেন। সঙ্গে ছিলেন আরেক সহকর্মী। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় আসার পর রুপার ওই সহকর্মী নেমে গিয়ে ঢাকার উদ্দেশে অন্য গাড়িতে ওঠেন। ময়মনসিংহে এক আত্মীয়ের বাসায় রাত কাটিয়ে পরদিন শেরপুর শহরের কর্মস্থলে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রুপা আর গন্তব্যে পৌছাতে পারেননি। ওই বাসের ভেতর তিন হেলপার তাকে একে একে ধর্ষণ করে পৈশাচিক কায়দায় খুন করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে রক্তাক্ত লাশ। পুলিশের হাতে আটক হয়েছে তিন ধর্ষক ছাড়াও বাসের চালক ও সুপারভাইজার। তারা এই গণধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে।
রুপার বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামের। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করে ঢাকার আইডিয়াল ল’ কলেজে এলএলবিতে শেষ পর্বে পড়াশোনা করছিলেন। একই সঙ্গে পরিবারকে সাহায্যের জন্য বছর খানেক আগে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে শেরপুরে চাকরি নেন।
মধুপুর থানা পুলিশ জানায়, গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে তারা খবর পান টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর জঙ্গলের পঁচিশ মাইল এলাকায় এক তরুণীর রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। লাশটি উদ্ধার করে টাঙ্গাইল মর্গে ময়না তদন্ত শেষে শনিবার ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসাবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও প্রিন্ট মিডিয়ায় নিহত তরুণীর ছবি দেখে তার বড় ভাই হাফিজুর রহমান সোমবার মধুপুর থানায় যান। সেখানে তিনি থানায় রাখা ছবি দেখে তার বোন বলে সনাক্ত করেন। তখন পুলিশ নিশ্চিত হয় হতভাগ্য এই তরুণীই রুপা। রুপার ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রুপা সবার ছোট। সে খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল।
যেভাবে ধর্ষণ ও হত্যা: আটককৃতদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, রুপার বাসটি বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে কালিহাতির পর সব যাত্রী একে একে নেমে যায়। রাতে যাত্রী হিসেবে একা রুপাকে পেয়ে তিন হেলপার তাকে উত্যক্ত করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ওই তিনজন দরজা জানালা সব বন্ধ করে চলন্ত বাসেই তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। গাড়ির চালক ও সুপারভাইজার ওই তিনজনকে বাধা না দিয়ে এতে উত্সাহ দেয়। রুপা তার টাকাপয়সা সব নিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় বাসটি মধুপুরের কাছাকাছি চলে এলে তিনি বাঁচাও বাঁচাও বলে সাহায্যের জন্য চিত্কার শুরু করেন। তখন ধর্ষকরা তাকে বাসের মেঝেতে ফেলে সর্বশক্তি দিয়ে তার ঘাড় ভেঙে দেয়। এরপর গাড়ির মেঝেতে ফেলে আছাড় দিয়ে দিয়ে তার মাথা ভেঙে ফেলে। ফলে গাড়ির ভেতর রক্তে ভেসে যায়। মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর রুপার পার্সে থাকা পাঁচ হাজার টাকা এবং মোবাইল সেট নিয়ে নেয় তারা। বাসের ভেতর লাশ থাকার কারনে মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী না তুলে খালি বাসটি সোজা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে চালিয়ে যায় তারা।
পুলিশ আরো জানায়, মধুপুর বনাঞ্চল পাড়ি দেয়ার সময় ধর্ষকরা সেখানেই রুপার লাশ জানালা দিয়ে জঙ্গলে ছুড়ে ফেলে। পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর তার পরিচয় জানতে না পারায় পরদিন গণমাধ্যমে ‘অজ্ঞাত তরুণীর লাশ উদ্ধার’ মর্মে খবর ছাপা হয়।
এই ঘটনায় আটক হেলপার আকরাম, শামীম ও জাহাঙ্গীরকে গতকাল মঙ্গলবার টাঙ্গাইল আদালতে প্রেরণ করলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। চালক হাবিব এবং সুপারভাইজার সফর এ রির্পোট লেখা পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে ছিল। নিরাপদ পরিবহনের বাসটিও আটক করে পুলিশ। রুপার ব্যবহূত মোবাইলটিও উদ্ধার করা হয়েছে।
মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ ঘটনায় যে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সবাই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার বাসিন্দা। জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। আর আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে রুপার লাশ কবর থেকে তুলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা গোলাম মোস্তফা জানান, আদরের মেয়ে রুপার এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডে তার আসানবাড়ি গ্রামে শোকের মাতম চলছে। খবরটি প্রচার হবার পর গ্রামবাসী ও স্বজনরা তাদের বাড়িতে এসে পরিবারের সঙ্গে সমবেদনা প্রকাশ করছেন। মেধাবী মেয়ের এই পরিণতি মেনে নিতে পারছেন তা তারা। তারা খুনিদের কঠোর সাজা দাবি করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, ৩০ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসপি