আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ছিলেন স্বৈরাচারী সরকারের এক সময়ের নৌপরিবহন মন্ত্রী। কিন্তু তার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ছিল সারা দেশের সড়ক পরিবহন খাতে। সড়ক পরিবহনের বৈধ-অবৈধ প্রায় ১ হাজার সংগঠনের মাধ্যমে চাঁদাবাজির এক নিরাপদ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি। এর পাশাপাশি এক যুগ আগে থেকেই দেশের বিকশিত গার্মেন্ট সেক্টরেও তিনি থাবা বসান। সড়ক পরিবহনে ৯৩২ সংগঠনের নিয়ন্ত্রক তিনি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। এর পাশাপাশি ২০১৩ সালে ৫২টি গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠন করেন গার্মেন্ট শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। এ সংগঠনেরও প্রধান তিনি। ঢাকার আশুলিয়া ও গাজীপুরের সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে শাজাহান খানের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে শাজাহান খানের নিয়ন্ত্রিত সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারা দেশে প্রতিদিন তাদের বৈধ-অবৈধ ৯৩২টি সংগঠনের মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি টাকার বেশি সরাসরি শাজাহান খানের কাছে পৌঁছাত বলে জানা গেছে। পরিবহন খাতের ‘সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত শাজাহান খানের সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজির ব্যাপারে তার সংগঠনের নেতারাই সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিকার দাবি করেছেন।
শাজাহান খানের উত্থান ১৯৭২ সালের শুরুতে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে। ওই বছরই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি। এরপর ১৯৮০ সালে ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯৯৪ সালে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে শ্রমিকদের এ সংগঠনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক তিনি। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার কারণে শাজাহান খানের জন্য সড়কে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে সারা দেশের যানবাহন থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। এ ব্যাপারে পরিবহন শ্রমিক নেতা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, শাজাহান খানের নির্দেশে পুরো পরিবহন খাত চলত। তার কাছেই জিম্মি ছিল দেশের সড়ক পরিবহন খাত। পরিবহন শ্রমিকদের উন্নয়নে কোনো অবদানই ছিল না তার। প্রতিদিন সড়ক থেকে ১০ কোটির বেশি টাকা তুলত তার ফেডারেশন। কিন্তু সেসব টাকা শ্রমিকদের কোনো কাজেই আসত না। সড়কে তার দাপট শুরু হয়েছিল পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন দিয়ে। সেখান থেকে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হয়ে এ খাতের সম্রাট হয়ে ওঠেন তিনি। ক্ষমতা ও দাপটে হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন তিনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শাজাহান খানের সার্বিক পরিবহনের ৩২টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো তিনিও গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। গতকাল ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার হন তিনি।
সম্প্রতি গাজীপুর-আশুলিয়ায় গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আন্দোলনরত তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে শাজাহান খানের যোগাযোগ রয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানতে পেরেছে। উল্লেখ্য, সড়ক পরিবহন খাতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক শাজাহান খান সড়ক পরিবহনের পাশাপাশি এক সময় হাত বাড়ান পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর দিকে। ২০১৩ সালে ৫২টি গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠন করা হয় গার্মেন্ট শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। এ সংগঠনেরও প্রধান তিনি। এ সংগঠিত তৈরি পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে রাজধানীতে গত এক যুগে অনেকবার জোরালো আন্দোলন করেছেন শাজাহান খান। শ্রমিক নেতা হিসেবে গার্মেন্ট মালিকদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে।