আবসাল শাকিব কোরেশী ও নারী উদ্যোক্তা কাকলী খান। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে বিয়ে করেন তারা। বিয়ের আগে শাকিব তাঁকে বলেছিলেন, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন যেতেই কাকলী জানতে পারেন, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করছেন তাঁর স্বামী। এর পরও দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে শাকিবের সংসার করতে চেয়েছেন তিনি। অথচ তাঁর সঙ্গে শাকিব প্রতারণা করেছেন। একের পর এক তালাক নোটিশ পাঠিয়ে নাটক করা হয়েছে। এরই মধ্যে কাকলীর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যাসন্তান। স্ত্রী ও সন্তানের অধিকারের জন্য ওঠেন শাশুড়ির বাসায়। সেখানে উল্টো নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশ ডেকেও সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ কাকলীর। নির্যাতনের এ ঘটনা ঘটেছে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাসে ৮৫ নম্বর বাড়িতে।
কাকলীর অভিযোগ, নির্যাতনের শিকার হয়ে কলাবাগান থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে গত ৪ মার্চ আদালতে মামলা করেন। মামলায় বিয়ের শুরু থেকে নানা সময় স্বামীর কাছ থেকে নির্যাতিত, প্রতারিত ও সর্বশেষ হামলার শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এতে শাকিব ও তাঁর দুলাভাই প্রবাসী সৈয়দ হোসেন টুটুলসহ অজ্ঞাত ছয়-সাতজন কাকলী, তাঁর শিশুসন্তান ও মায়ের ওপর হামলা চালিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য ১৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় শাকিবও আদালতে একটি মামলা করেন কাকলীর বিরুদ্ধে। এতে তিনি অভিযোগ করেন, কাকলী ও তাঁর ভাই দখলের উদ্দেশ্যে লেক সার্কাসের ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। ইউএসএআইডির প্রকল্প ফিড দ্য ফিউচার ট্রেড কম্পোনেন্টে শাকিব জেন্ডার এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করেন।
দিনার কাজী কাকলী ওরফে কাকলী খান (৩৯) একজন নারী উদ্যোক্তা। তিনি ‘শুদ্ধ কৃষি’ নামে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। ব্যবসায়িক সূত্রে আবসাল শাকিব কোরেশী ওরফে ফাল্গুনের (৫৭) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। শাকিব ২০২১ সালের শুরুর দিকে কাকলীকে জানান, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে; তিনি তাঁকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চান। প্রথমে রাজি না হলেও পরে কাকলী সায় দেন। ওই বছরের ২৭ জুন হলফনামার মাধ্যমে বিয়ে হয় তাদের। কয়েক মাস পর রেজিস্ট্রেশন কাবিননামা করা হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিজ বাসায় তোলেননি শাকিব। স্ত্রীকে বলেছিলেন, বাসায় তাঁর বৃদ্ধা মা ও দুই সন্তান আছে। পরে পরিস্থিতি বুঝে তিনি তাঁকে বাসায় তুলবেন। কাকলী গ্রিন রোডে মা-বাবার বাসায় থাকেন। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন শাকিব। কাকলী শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইলে টালবাহানা শুরু করেন শাকিব।
কাকলী জানান, তিনি ২০২২ সালের মে মাসে কন্যাসন্তান জন্ম দেন। এর পর স্বামীর অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। চারবার তালাকের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আবেদন করে তা শাকিবই আবার প্রত্যাহার করে নেন। একজন সাবেক আমলার বাসায়ও তারা মীমাংসার জন্য বসেছিলেন। সংসার করবেন বলে শাকিব ওই আমলাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেটিও ভঙ্গ করেন। শাকিবের চাচা আলী আশকারকেও পারিবারিকভাবে বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন কাকলী। তিনি কথা দেন পারিবারিকভাবে স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দেবেন। তাঁর পরামর্শে কাকলী গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০ মাস বয়সী কন্যা ও মাকে নিয়ে লেক সার্কাস ৮৫ নম্বর ভবনের ৪সি ফ্ল্যাটে শাশুড়ি সৈয়দা আয়শা খাতুনের কাছে যান। এ সময় ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ তুলে ৯৯৯-এ ফোন করে শাশুড়ি পুলিশ ডাকেন। পরে পুলিশ এসে উভয়ের বক্তব্য শুনে পারিবারিকভাবে মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলে চলে যায়। এরই মধ্যে আলী আশকার যান সেখানে। তিনি সৈয়দা আয়শাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি ঘর খোলা রেখে সবগুলোতে তালা লাগিয়ে যান। কাকলী, তাঁর মেয়ে ও মা ওই বাসায় থাকেন। পরদিন মীমাংসার কথা ছিল।
কাকলী বলেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে মর্জিনা নামে এক গৃহকর্মী দরজায় টোকা দেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সাত-আটজন আমাদের মা-মেয়েসহ তিনজনের ওপর হামলা চালান। হামলাকারীদের মধ্যে আমার ননদের স্বামী টুটুল ও চাচা শ্বশুরের ক্লিনিকের কর্মচারীরা ছিল। পরে চিৎকার শুনে অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, শাকিব আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমার শিশুসন্তানের সঙ্গেও প্রতারণা করছেন। সন্তানের পিতৃত্বের অধিকার এবং আমাদের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিচার চাই। গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে শাকিব সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।
ভবনটির সদ্য সাবেক নিরাপত্তাকর্মী ফুয়াদ জানান, ঘটনার রাতে তিনি দু’জন অচেনা লোককে ওই বাসায় যেতে দেখেন। গেটের বাইরে আরও একজন ঘোরাঘুরি করছিল। এক-দেড় ঘণ্টা পর কাকলী খান নিচে এসে কান্নাকাটি করছিলেন। তিনি বলছিলেন, তাঁকে খুব মারধর করা হয়েছে। এর পর দু’জন লোক বেরিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান।
শাকিবের চাচা আলী আশকার বলেন, কাকলী শাকিবের দ্বিতীয় স্ত্রী। ওই সংসারে মেয়ে সন্তান হয়েছে। আমি মনে করি, এখনও মিটমাট করার সময় আছে। তারা সংসার করুক, এটাই চাই।
শাকিবের বক্তব্য নিতে একাধিকবার মোবাইলে কল করা হলেও তিনি ধরেননি।
মামলা না নেওয়ার বিষয়ে কলাবাগান থানার ওসি মফিজুল আলম বলেন, ধর্তব্য কোনো অপরাধের তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় মামলা নেওয়া হয়নি। পাঁচ-ছয়জন অজ্ঞাত নারী কাকলীকে বাসা থেকে জোর করে বের করে দিয়েছিলেন। তবে পরে তিনি আদালতে মামলা করেন। সেটি তদন্ত চলছে।