তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ঢাকা ও গাজীপুরের ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩০০ কোটি টাকা পাচারের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরমধ্যে ঢাকার সাতটি, গাজীপুরের দুটি ও সাভারের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, সৌদি আরব ও কাতারে রপ্তানি দেখিয়ে বিপুল এ অর্থ পাচার করেছে বলে জানিয়েছেন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ঢাকার যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খান।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শনাক্ত হওয়া ১০ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো, প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড (আশুলিয়া, সাভার); ফ্যাশন ট্রেড (গুলশান, ঢাকা); এমডিএস ফ্যাশন (উত্তরা, ঢাকা); হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড (টঙ্গী, গাজীপুর), থ্রি-স্টার ট্রেডিং (বনানী, ঢাকা); ফরচুন ফ্যাশন (মিরপুর, ঢাকা); অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড (কচুক্ষেত, ঢাকা); পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড (টঙ্গী, গাজীপুর); স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড (শাহবাগ, ঢাকা) এবং ইডেন স্টাইল টেক্স (খিলক্ষেত, ঢাকা)।
গতকাল দুপুরে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ঢাকার যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি পোশাক পণ্যের চালান বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, এ কারণে পণ্যমূল্য বা বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কাজ শুরু করে।
পরে জানা যায়, তারা জালিয়াতি করে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে এবং বিল অব এক্সপোর্টের ২৪ নম্বর কলামে নমুনার কোড ২০ ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হয়ে পুরো রপ্তানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তদন্তকালে ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে এক হাজার ২৩৪টি পণ্যচালানে এমন জালিয়াতি করেছে। রপ্তানি সম্পন্ন হওয়া এসব চালানের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণ ৯ হাজার ১২১ মেট্রিক টন, যার প্রত্যাবাসনযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার সম্ভাব্য পরিমাণ ৩,৫৩,৬৬,৯১৮ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানসমূহ টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি দেখিয়ে অর্থপাচার করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে ওই ব্যাংক সম্পর্কিত নয়। ফলে ব্যাংকটির মাধ্যমে বিল অব এক্সপোর্টে উল্লিখিত সেলস কন্ট্রাক্ট বা ইএক্সপির রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসিত হয়নি বা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড (আশুলিয়া, সাভার): প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে ৩৮৩টি এবং ২০২০ সালে আটটিসহ মোট ৩৯১টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব পণ্য চালানে মোট ৩ হাজার ৮০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, পাজামাসহ বিভিন্ন পণ্য ছিল। যা সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি হওয়া এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯২ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা)।
ফ্যাশন ট্রেড (গুলশান, ঢাকা): এই প্রতিষ্ঠানটির ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬টি এবং ২০১৮ সালে ৫৭টিসহ মোট ২৪৬টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেসব চালানে ১ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, টপ, পাজামাসহ বিভিন্ন রকমের পণ্য ছিল। এসব পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। পণ্যগুলোর মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার (৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা প্রায়)।
এমডিএস ফ্যাশন (উত্তরা, ঢাকা): এই প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালে ১৮২টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। পণ্য চালানগুলোতে ১ হাজার ৩৭৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট ছিল; যার অধিকাংশই সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, কাতার ও ফিলিপাইনে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ মার্কিন ডলার (৪৪ কোটি ১ হাজার ৫৫১ টাকা প্রায়)।
হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড (টঙ্গী, গাজীপুর): ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে, তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটির ১৫৬টি রপ্তানি চালানে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব চালানে ১ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করা হয়েছে। যার অধিকাংশেই সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, কাতার, নাইজেরিয়া, কুয়েত ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। আলোচ্য চালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৪৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ মার্কিন ডলার (৪০ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৬ হাজার টাকা প্রায়)।
থ্রি-স্টার ট্রেডিং (বনানী, ঢাকা): ২০২০ সালে ১২০টি রপ্তানি চালানের জালিয়াতি করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্য চালানগুলোতে ৮১৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। যার অধিকাংশই মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, কানাডা, মিসর প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। চালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ১০৮ মার্কিন ডলার (২৫ কোটি ১২ লাখ ৮ হাজার ৮৬৯ টাকা প্রায়)।
ফরচুন ফ্যাশন (মিরপুর, ঢাকা): ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ৫৯টি রপ্তানি চালানের জালিয়াতি করেছে এই প্রতিষ্ঠান, যার প্রমাণ পাওয়া যায়। রপ্তানিকৃত পণ্য চালানগুলোতে ৪৩৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের অধিকাংশই সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, মিসর ও কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। রপ্তানি হওয়া এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮১৩ মার্কিন ডলার (১২ কোটি ৯৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৩ টাকা প্রায়)।
অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড (কচুক্ষেত, ঢাকা): এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ৪২টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৯৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। যার বেশিরভাগই সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, জর্জিয়া ও মালয়েশিয়াসহ প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি হওয়া এসব পণ্যের মূল্য ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ ডলার (৭ কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০৩ টাকা প্রায়)।
পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড (টঙ্গী, গাজীপুর): ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি ২০টি রপ্তানি চালানের মাধ্যমে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পণ্যচালানগুলোতে ১৭০ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, কুয়েত, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া ও শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশেই এসব পণ্যের বেশিরভাগ পাঠানো হয়েছে। পণ্যগুলোর মূল্য প্রায় ৫ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ মার্কিন ডলার (৫ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা প্রায়।
স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড (শাহবাগ, ঢাকা): প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে ১০টি রপ্তানি চালানে অর্থপাচার করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব চালানে ৬৬ দশমিক ৮ মেট্রিক টন পণ্য ছিল। বেশিরভাগ পণ্য গেছে ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, স্নোভেনিয়া ও পানামায়। এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ মার্কিন ডলার (২ কোটি ১৭ লাখ ২ হাজার ৯০২ টাকা প্রায়)।
ইডেন স্টাইল টেক্স (খিলক্ষেত, ঢাকা): ২০২০ সালে আটটি রপ্তানি চালানে জালিয়াতি করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। রপ্তানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৪২ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে ইডেন স্টাইল টেক্স। বেশিরভাগ পণ্যই রপ্তানি হয়েছে টোঙ্গা, ওমান, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে। রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮ মার্কিন ডলার (১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা প্রায়)।
কাস্টমস গোয়েন্দা জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রপ্তানিকৃত পণ্য হলো টি-শার্ট এবং প্রতি পিসের ওজন দেখানো হয়েছে ৫০০/৮০০/১০০০ গ্রাম বা তারও বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি নিট ফেব্রিক্স দিয়ে কমপক্ষে ৩ থেকে ৬টি লং স্লিভ টি এল সাইজ টি-শার্ট হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় প্রতিটি টি-শার্টের গড় ওজন ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম ধরে রপ্তানিকৃত টি শার্টের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু পণ্যচালানে রপ্তানি পণ্যের মূল্য খুবই কম ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সমসায়িক রপ্তানি চালানের সমজাতীয় পণ্যের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট বিল অব এক্সপোর্টে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করেছে।