সেই যুবক মা-মেয়েকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যার কারণ জানাল পুলিশ

সেই যুবক মা-মেয়েকে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যার কারণ জানাল পুলিশ। বিস্তারিত নিচের ছবিতে
স্থানীয়রা পালিয়ে যাওয়ার সময় এক যুবককে আটক করে - সংগৃহীত ছবি

নোয়াখালীতে পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে টাকা নিয়ে টানাপোড়েনে মা-মেয়েকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেছেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম। আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সুধারাম মডেল থানা প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম এসব বলেন।

এর আগে নোয়াখালী জেলা শহরের মাইজদীর বারলিংটন মোড় এলাকায় বাসায় ঢুকে মা-মেয়েকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা আলতাফ হোসেন নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। আলতাফ লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর মেহের গ্রামের বাসিন্দা।

আজ বুধবার সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে ঘটে এ ঘটনা।

নিহতরা হলেন, নোয়াখালী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ফজলে আজিম কচির স্ত্রী নুর নাহার বেগম (৪৪) ও হরিনারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি বছরের এসএসসি ফল প্রার্থী মেয়ে ফাতিহা আজিম প্রিয়ন্তী (১৬)।

সংবাদ সম্মেলনে এসপি বলেন, ভিকটিম নূর নাহার বেগমের সঙ্গে প্রবাসে থাকা অবস্থায় রং নম্বরের সূত্র ধরে পরিচয় হয় আসামি আলতাফের। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর নুর নাহার বেগম আসামি আলতাফকে ওমান থেকে দেশে এসে ব্যবসা করতে বলে এবং ব্যবসার সম্পূর্ণ মূলধন এবং তার সব দেনা বহন করার আশ্বাস দেয়। এ আশ্বাসে এক সপ্তাহ আগে আসামি ওমান থেকে ভিসা বাতিল করে সব ছেড়ে দেশে চলে আসে। দেশে এসে আসামি নুর নাহার বেগমের বাসায় চার-পাঁচবার গিয়ে ব্যবসার টাকা চায়। তবে নুর নাহার বেগম ব্যবসার টাকা দিতে তালবাহানা করতে থাকেন। বুধবার ১৪ জুন সকাল ১০টার দিকে পুনরায় টাকা চাওয়ার জন্য আসামি ভিকটিমের মাইজদী শহরের বার্লিংটন মোড়ের হক মঞ্জিলের বাসায় যান। তখন টাকা চাইলে ভিকটিম টাকা দিতে অস্বীকার করেন।

এসপি আরো বলেন, এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে নুর নাহার বেশি বাড়াবাড়ি করলে আলতাফকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। একপর্যায়ে আসামিকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে উদ্যত হন। এতে আসামি আলতাফ ক্ষিপ্ত হয়ে তার সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে নুর নাহারকে তার কক্ষের ভেতর উপর্যুপরি আঘাত করেন। মেয়ে ফাতিহা আজিম প্রিয়ন্তী মায়ের চিৎকারের শব্দ শুনে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসলে আসামি আলতাফ তাকেও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে প্রিয়ন্তী দৌড়ে নিচতলার ভাড়াটিয়ার বাসার দরজায় ধাক্কা দিলে ভাড়াটিয়া দরজা খুলে দেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ন্তী ডাইনিং রুমের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে। প্রিয়ন্তীর পিছু পিছু আসামি আলতাফ হোসেন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পুলিশ তাকে আটক করে।

পুলিশ জানায়, আলতাফ হোসেনকে থানা হেফাজতে নিয়ে পুলিশ বিভিন্ন ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে আসামি পুলিশের কাছে উপরোক্ত ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত জানায় এবং হত্যায় ব্যবহৃত ছুরির কভার তার দেওয়া তথ্য মতে মেস থেকে জব্দ করা হয়। হত্যায় ব্যবহৃত ছুরিও জব্দ করা হয়েছে। নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে মর্গে প্রেরণ করা হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত নূর নাহারের স্বামী ফজলে আজিম কচি শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। বুধবার সকাল ৯টার দিকে তিনি বাসা থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যান। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারেন তার বাসায় ডাকাত ঢুকেছে। তাৎক্ষণিক তিনি বাসায় এসে স্ত্রীর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। পরে জানতে পারেন, হাসপাতালে নেয়ার পর তার মেয়েও মারা গেছে।

বার্লিংটন মোড়ের মমতাজ ফার্মেসির মালিক আমিন উল্যাহ জানান, ওই বাসার ভাড়াটিয়াদের চিৎকার শুনতে পেয়ে আমি দ্রুত সেই বাসায় যাই। দোতলা ভবনের নিচতলায় প্রিয়ন্তী রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে দেখতে পাই। পাশেই এক যুবককে দেখলাম তার সারা শরীরে রক্তের ছাপ লেগে আছে। এ সময় প্রিয়ন্তী কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কথা বলতে পারছিল না। সে হাতের ইশারায় ওই যুবককে আমাকে দেখায়। তাকে আটক করতে চাইলে প্রথমে সে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী এগিয়ে এসে তাকে প্রায় ২০০ মিটার ধাওয়া করে আটক করা হয়। পরে স্থানীয়রা প্রিয়ন্তীদের দোতলার বাসায় গিয়ে দেখেন তার মা নুর নাহার বেগমও রক্তাক্ত অবস্থায় এক কক্ষে পড়ে রয়েছেন। আমরা প্রিয়ন্তীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করি।

ওই ভবনে বসবাসকারী এক ভাড়াটিয়া নারী জানান, সকালে দ্বিতীয় তলা থেকে চিৎকার করতে করতে প্রিয়ন্তী রক্তাক্ত অবস্থায় দরজার সামনে আসে। পরে দরজা খুলে দিলে সে মেঝেতে পড়ে যায়। এ সময় তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।

ফজলে আজিম কচির ছোট ভাই, জাকির হোসেন প্রিন্স কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, চিৎকারের আওয়াজ শুনে গিয়ে দেখি আমার ভাতিজি নিচতলায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখি ভাবির লাশ।

তিনি বলেন, সম্ভবত ভাবিকে আগে মেরেছে পরে ভাতিজিকে। স্থানীয়দের সহযোগিতায় হসপিটালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রিয়ন্তীকে মৃত ঘোষণা করেন। আমি এমন হত্যার বিচার চাই।

প্রতিবেশী ও স্বজনরা জানান, ঠিক কারণে এমন ঘটনা ঘটলো তা কারো বুঝে আসছে না। নুর নাহার বেগম খুবই সদালাপী নারী ছিলেন। স্থানীয় কারো সঙ্গে কোনো সমস্যা ছিলো না।

এদিকে এ ঘটনায়, বিকেল ৪টার দিকে জেলা শহরের হরিনায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ স্থানীয়রা বিদ্যালয়ের সামনের প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। এ সময় সোনাপুর-চৌমুহনী সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।

ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ চলে। পরে বিকেল ৫টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোর্তাহিন বিল্লাহ ও সুধারাম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ঘটনাস্থলে গিয়ে হত্যার বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা সড়ক অবরোধ তুলে নেয়।