রাজধানীতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মাথা-হাত-পা কেটে স্বামীকে হত্যা

রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে টুকরা করা লাশ উদ্ধারের ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল সোমবার দুপুরে বনানী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিহত ময়না মিয়ার স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকেই টুকরা করা লাশের রহস্য উন্মোচন করে ডিবি।

আজ মঙ্গলবার (১ জুন) দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ময়না মিয়া হত্যাকাণ্ডের ধরণ, মোটিভ এবং অপরাধী সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, গতকাল দুপুর ১২ টায় গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের একটি টিম বনানী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ময়না মিয়ার খণ্ডিত লাশের রহস্য উন্মোচনসহ এক জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতের নাম ফাতেমা খাতুন। তিনি ভিকটিমের প্রথম স্ত্রী।

তিনি জানান, রঙের পানির ড্রামে কেটে ফেলা দুই পা এবং দুই হাতকে একটি বড় কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে নিহত ময়না মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। এলাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে প্রথমে মাথা ও হাত-পা খণ্ডিত শরীরের মূল অংশ ফেলে দেয় আমতলী এলাকায়। এরপর মহাখালী বাস-টার্মিনাল এলাকায় এনা বাস কাউন্টারের সামনে খণ্ডিত দুই হাত-পা ভর্তি ব্যাগ রেখে দিয়ে চলে আসে বাসায়। বাসায় এসে সেখান থেকে খণ্ডিত মাথার ব্যাগটি নিয়ে বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে গুলশান লেকে ফেলে দেয় এবং এরপর বাসায় এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকে।

ময়না মিয়া নামের এক যুবকের তিন স্থানে শরীরের খণ্ডিত বিভিন্ন অংশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটনের পর এভাবেই লোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছিলেন ডিবির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ডিবি গুলশান বিভাগের একটি টিম ভিকটিমের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তার নিখোঁজ হওয়া স্বামীর বিষয় নিশ্চিত হয়। ডিসি ডিবি মশিউর রহমান, এডিসি সাকলায়েন ও এডিসি রেজাউল হকের নেতৃত্বে অপর একাধিক টিম দুপুর ১২টা থেকে গোয়েন্দা তথ্য এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত আসামিকে আটকের অভিযান চালায় মহাখালী ও বনানী এলাকায়। একটা পর্যায়ে গোয়েন্দা পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, ভিকটিম বনানী থানাধীন কড়াইল এলাকাতে তার প্রথম স্ত্রীর ফাতেমার সঙ্গে কয়েকদিন ধরে বসবাস করছিল। এই তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ বনানী থানার রোড নাম্বার ৪, বাসা নাম্বার ১৮ র একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কোম্পানি অফিস থেকে আসামি ফাতেমা খাতুনকে গ্রেফতার করে।

রবিবার (৩০ মে) দিবাগত রাত ৯ টার দিকে প্রথমে মহাখালীর আমতলীর কাঁচাবাজারের মসজিদ গলিতে মাথা ও দুই হাত এবং দুই পা ছাড়া বস্তাবন্দি অবস্থায় পড়ে থাকা একটি খণ্ডিত মৃতদেহ উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ। এর মাত্র ৪ ঘণ্টা পর রাত ১ টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে তেজগাঁও থানা পুলিশ দুটি হাত ও দুটি পা উদ্ধার করে। পরে সেগুলো আগে উদ্ধার হওয়া খণ্ডিত মৃতদেহের বলে নিশ্চিত করে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। সেই সংগে ওই হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট থেকে সিআইডি নিশ্চিত হয় যে উদ্ধার হওয়া মৃতদের নাম ময়না মিয়া (৩৮)।

তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদরের উত্তর বৌলায়। বাবা মৃত তোতা মিয়া। এরপরই পুলিশ তার গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করলে জানতে পারেন ময়না মিয়ার দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী ফাতেমা খাতুন ঢাকায় থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন গ্রামে থাকে। ময়না মিয়া ঢাকায় ফাতেমার সঙ্গে থাকতেন নিশ্চিত হওয়ার পর গোয়েন্দা পুলিশ ফাতেমাকে খুঁজে বের করলেও হত্যাকাণ্ডের সব রহস্য উন্মোচিত হয়। মাত্র ২৪ ঘনটার মধ্যেই ময়না মিয়াকে হত্যার সব রহস্য উদঘাটন এবং ময়না মিয়ার খণ্ডিত মাথাও উদ্ধার করে পুলিশ।

কি ঘটেছিলো সেদিন?

ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন বলেন, গ্রেফতারকৃত ফাতেমা আমাদেরকে জানিয়েছে, গত ২৩ তারিখ থেকে তার স্বামী ময়না মিয়া কড়াইল এলাকায় তার বাসাতেই অবস্থান করে। পারিবারিক কলহ, টাকা পয়সা বণ্টন ও একাধিক বিবাহকে কেন্দ্র করে ময়না মিয়ার সঙ্গে তার মনোমালিন্য হচ্ছিল। এক পর্যায়ে ফাতেমা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বামী ময়না মিয়াকে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে নিস্তেজ করে এবং পরবর্তীতে তাকে জবাই করে হত্যা করে লাশ গুম করে। পরিকল্পনা মোতাবেক কড়াইল এলাকা থেকে ফাতেমা দুই পাতা ঘুমের ট্যাবলেট ক্রয় করে শুক্রবার রাতে জুসের সঙ্গে ভিকটিমকে খাইয়ে দেয়।

সারারাত সারাদিন ভিকটিম ঘুমে অচেতন থাকলে সন্ধ্যার দিকে কিছুটা সম্বিত ফিরে পায় এবং তার স্ত্রীকে গালমন্দ করে আক্রমণ করতে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ভিকটিম পানি পানি বলে আর্তনাদ করলে ফাতেমা ঘুমের ট্যাবলেট মিশানো জুস আবার তার মুখে ঢেলে দেয়। এক পর্যায়ে ভিকটিম নিস্তেজ হয়ে খাটে পড়ে গেলে আটককৃত ফাতেমা তার ওড়না দিয়ে আসামির দুই হাত শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখে এবং ভিকটিমের মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকে দেয়। ক্ষীণ আর্তনাদ করতে থাকা ভিকটিমের বুকের উপরে বসে গ্রেফতারকৃত ফাতেমার বাসায় থাকা নতুন ধারালো স্টিলের চাকু দ্বারা ভিকটিমের গলা কাটা শুরু করে।

ফাতেমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে ভিকটিম নিজের হাত মুক্ত করে ফাতেমার হাতে খামচি এবং কামড় বসিয়ে দেয়। এতে ফাতেমা রাগ আরও বেড়ে যায়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ভিকটিম ও আটককৃত ফাতেমা দুজনেই খাট থেকে পড়ে গেলে ফাতেমা ভিকটিমের বুকের উপরে উঠে তার গলার বাকি অংশ কেটে দেয়। এভাবে রাত অতিবাহিত হলে সকালবেলা আটককৃত ফাতেমা লাশ শুম করার জন্য ধারালো চাকু দিয়ে ভিকটিমের হাতের চামড়া ও মাংস কাটে এবং ধারালো দাঁ দিয়ে হাড় কেটে খণ্ডিত অংশকে তিনটি ভাগে রাখে।

একটি লাল রঙের কাপড়ের ব্যাগে মাথা, শরীরের মূল অংশকে একটি নীল রঙের পানির ড্রামে এবং খণ্ডিত দুই পা ও দুই হাতকে একটি বড় কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। এরপর এলাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে প্রথমে আমতলী এলাকায় শরীরের মূল অংশ ফেলে দেয়। পরে মহাখালী এনা বাস কাউন্টারের সামনে খণ্ডিত দুই হাত ও দুই পা ভর্তি ব্যাগ রেখে দিয়ে চলে আসে বাসায়। বাসায় এসে সেখান থেকে খণ্ডিত মাথার ব্যাগটি নিয়ে বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে গুলশান লেকে ফেলে দেয় এবং এরপর বাসায় এসে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকে।

Scroll to Top