পৃথিবীতে প্রতারণার ধরণের যে শেষ নেই। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই যেনো নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট চুনাহাটি গ্রামের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রফিকুর আর এম এ মুনিম দম্পতির। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তারপর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মামলার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে পরিবারটির বিরুদ্ধে।
তাদের এমন ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হয়েছেন চিকিৎসক ও প্রবাসী যুবক।
আমেরিকান মেয়ে ও তার বাবা-মায়ের প্রতারণায় আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছেন মৌসুমীর দ্বিতীয় স্বামী সিলেটের যুবক জাকের আহমদ। আদালতের নির্দেশে অভিযোগ তদন্তক্রমে সত্যতা পেয়ে মামলা দায়ের করেছে এসএমপির এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ।
জাকের আহমদের মামলায় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট চুনাহাটি গ্রামের মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রফিকুর আর এম এ মুনিম, তার স্ত্রী ইমামা বেগম চৌধুরী ও মেয়ে শারমিন সুরভী মৌসুমীকেও আসামি করা হয়।
অভিযোগে জাকের আহমদ উল্লেখ করেন, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি শারমিন সুরভী মৌসুমীর সঙ্গে ২১ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য্যক্রমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। আগের বিয়ের তথ্য গোপন করে মেয়েকে কুমারী দেখিয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দেন মুনিম দম্পতি। বিয়ের ১৩ দিন পর ২৮ জানুয়ারি মেয়েকে নিয়ে স্বস্ত্রীক যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান মুমিন দম্পতি।
যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর মৌসুমী, তার মা মোবাইল ফোনে কথাবার্তা বলতেন। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের ২১ নভেম্বর মৌসুমী ফোন দিয়ে বলেন, তোমাকে যুক্তরাষ্ট্রে আনতে হলে মায়ের অ্যাকাউন্টে ২৫ লাখ টাকা দিতে হবে। এ খবর জানতে পেরে জাকেরকে তার মা বলেন, এতো টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি সাইপ্রাসে ছিলে আবার সাইপ্রাসে চলে যাও।
এরপর ২৫ নভেম্বর আবারো মৌসুমী বাবা-মার পরামর্শে ফোনে দিয়ে বলেন, তুমি আমার জন্য সিলেটের উপশহরে বাসা ভাড়া করবে। দেশে গেলে ওই বাসাতে উঠবো। তোমার বাবা-মার সঙ্গে থাকবো না। জাকের স্ত্রীকে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, মা-বাবার সঙ্গে থাকলে তোমার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মৌসুমীর মা ফোন নিয়ে বলেন, আমার মেয়ের কথা না শুনলে তোমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা হবে না।
এসব কথাবার্তা মৌসুমীর গ্রামের বাড়ি জৈন্তাপুরে গিয়ে স্বজনদের জানান জাকের। ওই সময় স্বজনদের মাধ্যমে জানতে পারেন মৌসুমীর আরেক বিয়ে হয়েছিল। ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফরিদ আহমদ নামে এক চিকিৎসকের সঙ্গে মৌসুমীকে বিয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা-মা। এ তথ্য তার কাছে গোপন রাখা হয়। ওই চিকিৎসকের ঔরসজাত একটি পুত্র সন্তানও রয়েছে। ২০১৫ সালের ৩ এপ্রিল সন্তান জন্ম দেন মৌসুমী।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হতে মৌসুমীর প্রাক্তণ স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন জাকের। ওই চিকিৎসক পরিবারও মৌসুমীর প্রতারণার ফাঁদে আর্থিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঘটনার সত্যতা জানতে পেরে যেনো বিনা মেঘে জাকেরের মাথায় বজ্রপাত হয়। নির্বাক, হতবাক হন তিনি।
তথ্য মতে, অভিযুক্ত বাবা-মায়ের সম্মতিক্রমেই ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই ডা. ফরিদের সঙ্গে মৌসুমীর বিয়ে হয় ৩০ লাখ টাকা দেনমোহরে। পরে বিভিন্ন অভিযোগ এনে মোহরানা আদায়ের জন্য পারিবারিক মামলা (নং-৩৯/২০১৮) দায়ের করেন মৌসুমী। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ সোলেনামা দাখিলের মাধ্যমে তা নিস্পত্তি হয়। এ বছরের ৫ জানুয়ারি ডা. ফরিদের কাছ থেকে এসব ঘটনা জানতে পারেন জাকের আহমদ।
অভিযোগে দেখা যায়, জাকেরের সঙ্গে ১৫ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে এবং দেনমোহর বাবদ ৬ লাখ টাকা মু’অজ্জল রেখে কাবিন সাব্যস্তক্রমে বিয়ে হয়। অভিযুক্তরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর কাবিনের কপি সংগ্রহ করে দেখা যায়, তাতে ২১ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। সেই সঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারের ৬ লাখ টাকার পরিবর্তে এক লাখ টাকা কর্তন দেখান সুকৌশলে। আর আগের বিয়ের কথাও গোপন রাখা হয়েছে।
মূলত আর্থিকভাবে লাভবান হতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মৌসুমীকে কুমারী দেখিয়ে বিয়ে দেন তার বাবা-মা। তাদের যোগাযোগীমূলে ভয়ঙ্কর প্রতারণার শিকার হয়েছেন জাকের। যে কারণে আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছেন বলে জানান তিনি।
আদালতে করা অভিযোগের সঙ্গে মৌসুমীর পূর্ববর্তী নিকাহনামা, সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে মামলার (৩৯/২০১৮) কপি, আরজি, জবাব, সোলেনামা ও রায় ডিক্রির ছায়ালিপি, মৌসুমীর বর্তমান বিয়ের ছবি ও পরবর্তী বিয়ের নিকাহনামা ফিরিস্তি দিয়ে দাখিল করেন জাকের।
আদালতের নির্দেশে তদন্তে সত্যতা পেয়ে এসএমপির এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ মৌসুমী ও তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গ করে প্রতারণার মাধ্যমে আগের বিয়ে গোপন করে বিবাহ সম্পন্ন করার অপরাধে মামলা (নং-৭(২)২০২১) দায়ের করেছে।
এসএমপির বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মুহাম্মদ মাইনুল জাকির বলেন, আদালতের নির্দেশে তদন্তে সত্যতা পেয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অন্যদিকে পারিবারিক আদালতে মৌসুমীর করা মামলার নথি ঘেটে দেখা যায়, সাবেক স্বামীর সঙ্গে ৩০ লাখ টাকা দেনমোহর মৌসুমীর বিয়ে হয় ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর। কাবিনের অর্থ থেকে সাত লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে স্বর্ণালঙ্কার বাবদ। সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে দায়ের করা মামলায় অবশিষ্ট ২৩ লাখ ছাড়াও প্রতিমাসে খরপোষ বাবদ ৬০ হাজার করে আরও এক লাখ ৮০ হাজার টাকাসহ ২৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা দাবি করেন মৌসুমী।
মৌসুমীর দ্বিতীয় স্বামী ভুক্তভোগী জাকের আহমদ বলেন, আমার মতো আর কেউ যেন মৌসুমী ও তার বাবা-মায়ের প্রতারণার শিকার না হয়, এ জন্য তিনি আদালতের স্মরণাপন্ন হয়েছেন।
তার বিশ্বাস ভঙ্গ করে টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার আত্মসাৎ ও প্রথম বিয়ে গোপন করায় মৌসুমী ও তার পরিবারের প্রতি ধিক্কার জানান তিনি।