মোহাম্মদ ওমর ফারুক
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ওরফে বড় ভাই রানাকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা। গতকাল সোমবার দুপুর ২ টার দিকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে নামার পর উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকা থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তাকে গ্রেফতার দেখায়। তার সঙ্গে আশরাফ নামে এক ব্যক্তিকেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের দুটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। এর আগে রেদোয়ানুল আজাদ রানার নামে পাসপোর্ট ইস্যু করতে পুলিশের পক্ষ থেকে পাসপোর্ট অধিদফতরের কাছে আপত্তি জানানো হয়। এরপরও ২০১৪ সালে গাজীপুরের একটি ভুয়া ঠিকানা দিয়ে রানা তার নিজের ও বাবা-মা’র নাম, জন্ম তারিখ ঠিক রেখে কীভাবে এমআর (মেশিন রিডেবল) পাসপোর্ট পেলো তা নিয়ে গোয়েন্দারা হতবাক হয়েছেন। রানা নতুন পাসপোর্টে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করেন। ব্লগার রাজীব হত্যা ছাড়াও উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা ও মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষককে হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি সে।
২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল বিন নাইম ওরফে দিপু (২২) ও সাবেক শিক্ষার্থী রেদোয়ানুল আজাদ রানা (৩০)। যাবজ্জীবন দন্ড পান মাকসুদুল হাসান অনিক (২৬)। বাকি পাঁচজনের মধ্যে এহসানুর রেজা রুম্মান (২৩), মো. নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ (১৯), নাফিজ ইমতিয়াজ (২২) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমুদ্দীন রাহমানীকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। এদের মধ্যে রানা পলাতক ছিলেন।
গতকাল কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে বাড়ির সামনে রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা তদন্ত করে রানাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। এই মামলায় রানা পলাতক ছিলেন। রানা পূর্বে পুরাতন পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। ২০১৪ সালে রানা নতুন পাসপোর্ট নিয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় যান। পরবর্তী সময়ে রানার জঙ্গি কার্যক্রমের তথ্য ও তার বিস্তারিত পরিচয় মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেওয়া হয়। পরে মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা রানাকে আটক করে।
মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, মালয়েশিয়ায় রানা বাংলাদেশ থেকে পলাতক জুনুন সিকদারের সঙ্গে মিলিত হন। জুনুন সিকদারের কাছ থেকে রানা সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বাইয়াত (শিষ্যত্ব) গ্রহণ করেন। জুনুন সিকদার সিরিয়ায় চলে গেলেও রানা তার সহযোগী আশরাফকে নিয়ে ফিলিপাইনে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আবু সায়েদ গ্রুপের সঙ্গে ফিলিপাইন গমন করার মনস্থির করেন। ওই সময় মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা রানাকে আটক করে। সোমবার দুপুরে একটি ফ্লাইটে রানাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ঢাকার ঝিগাতলার মনেশ্বর রোডের ১/৬/সি জুনুন সিকদারের বাড়ি।
রানার হাতে নতুন পাসপোর্ট থাকা প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ফেনীতে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও রানা নিজের নাম ও বাবা-মার নাম ঠিক রেখে গাজীপুরের একটি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নতুন পাসপোর্ট নিয়েছেন। আমরা রানাকে শনাক্ত করতে পারি ২০১৩ সালের শেষের দিকে। ওই সময় রানার পাসপোর্ট নম্বর নিয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে তার পাসপোর্টটি ব্লক করে দেওয়া হয় এবং তার বিদেশ গমনে ইমিগ্রেশনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নতুন পাসপোর্ট কীভাবে রানা পেল তা তদন্ত করা হচ্ছে। এর পেছনে পাসপোর্ট অধিদফতরের কেউ জড়িত আছে কি না অথবা পুলিশের কেউ জড়িত কি না তা তদন্ত করা হচ্ছে।
কে এই রানা: গ্রেফতার হওয়া রানার গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগন ভুঁইয়ার উত্তর জয়লস্করপুরে। রানার বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ। মায়ের নাম মমতাজ বেগম। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই- ব্লকের ১৮৭/সি নাম্বার বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। ১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট জন্ম নেওয়া রানার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানা যায়, ২০০৫ সালে ঢাকার আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি, ২০০৭ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরের বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। আর নর্থ সাউথে পড়ার সময় থেকে রানা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই রানার সঙ্গে পরিচয় হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা জসিম উদ্দিন রাহমানির। এরপর রানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবিটির সামরিক কমান্ডার সাবেক মেজর জিয়ার। রানা ও মেজর জিয়া মিলে গড়ে তোলে একটি কিলার গ্রুপ। ওই কিলারগ্রুপের তারা নাম দেয় স্লিপার সেল। সারাদেশে একাধিক স্লিপার সেল গঠন করে তারা। প্রতিটি স্লিপার সেলে ৫ থেকে ৭ জন করে সদস্য নিয়ে গঠিত হয়।