আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে গুজব নামক ছোঁয়াচে রোগের ভাইরাসে জর্জরিত আমাদের সমাজ। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গুজব নামক ভাইরাসটিও দিনে দিনে ছড়াচ্ছে মহামারির মতোই। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি, যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ভুল, অসংগত, ভিত্তিহীন, বানোয়াট তথ্যের সমন্বয়ে তৈরি হয় গুজব। সহজলভ্য, প্রযুক্তির এই যুগে গুজব ছড়াচ্ছে বাতাসের বেগে। কথায় আছে, হুজুগে বাঙালি। আসলেও তাই। সত্য-মিথ্যার বিচার-বিবেচনা না করেই আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার যেখানে যা দেখছি তা-ই মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি, যার দরুন আমাদেরই আতঙ্ক ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
আমাদের অবস্থা হয়েছে এমন, কেউ বলল তোমার কান নিয়ে যাচ্ছে চিলে, নিজের কানে হাত দিয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই আমরা চিলের পেছনে কান খুঁজতে ছুটছি। আমাদের সমাজে গুজব এত বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে এখন সত্য কোনো বিষয়ও আমাদের কাছে গুজব মনে হয়। আবার গুজবকেও সত্য বলে মনে হয়। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতেই আমাদের হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছে। কিছুদিন আগেও ছেলেধরা গুজবে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আট জন, যদিও এদের কেউই ছেলেধরা ছিল না। এক মা তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়েও ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে মর্মান্তিক হত্যার শিকার হতে হয়েছে।
আবার লবণের স্বল্পতার গুজবে বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে জনগণকে। এদিকে এই সুযোগে মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মুহূর্তেই বাড়িয়ে দিয়েছে লবণের দাম। মানে, সব মিলিয়ে এক হুলুস্থুল অবস্থা হয়েছে পুরো জাতির। আর এর জন্য দায়ীও গুজব রটনাকারী এবং আমাদের অসচেতনতায়। বর্তমানে করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বে এক মহামারিতে রূপ লাভ করেছে। আর এই করোনা ভাইরাস নিয়েও ফেসবুকে বিভিন্ন রকম গুজব ছড়াতে দেখা গিয়েছে। রোহান নামক ৩৫ সেকেন্ডের এক গুজব ছড়াতে দেখা গেছে এক ডাক্তারকে। কিছু অসাধু রাজনৈতিক নেতা মাঝেমধ্যে গুজবকে পুঁজি করে রাজনীতির মাঠ গরম করে, তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চায় আবার অনেক নেতা সত্যকে গুজব বলে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত। গুজব বর্তমান সময়ে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টের ভাইরাস স্বরূপ। অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে যেমন ভাইরাস দমন করা হয়, তেমনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের গুজবও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইনে গুজব ছড়ানো একটি জামিন অযোগ্য সাইবার অপরাধ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসত্ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য-উপাত্ত ছাড়া কোনো কিছু প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একজন সুশিক্ষিত সুস্থ নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো গুজবে কান না দেওয়া এবং সব ধরনের গুজব সম্পর্কে নিজের পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে গড়ে তোলা।