নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরের শান্তি প্রাসাদে (পিস প্যালেস) রোহিঙ্গাদের শান্তির সন্ধানে এক যুগান্তকারী মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে আজ। এই শান্তি প্রাসাদেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) অবস্থিত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালিয়ে মিয়ানমার বৈশ্বিক সনদ লঙ্ঘন করেছে কি না, তার বিচারই আইসিজের এই শুনানির উদ্দেশ্য। একই শহরের ১০ কিলোমিটারের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), যেখানে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এর আগে উত্থাপিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন।
আইসিজের মামলাটি যুগান্তকারী দুটি কারণে। প্রথমত, প্রতিবেশী না হয়েও বৈশ্বিক সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে মিয়ানমার থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের আরেকটি উপমহাদেশ আফ্রিকার রাষ্ট্র গাম্বিয়া এই মামলার বাদী। গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে এর আগে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে (সার্বিয়া বনাম বসনিয়া এবং সার্বিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়া)। দ্বিতীয়ত, এই প্রথম মানবাধিকারের লড়াইয়ের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একজন রাজনীতিক গণহত্যার সাফাই দিতে হাজির হচ্ছেন শান্তি প্রাসাদে।
১৯৯১ সালে শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ২৮ বছর পর সামরিক শাসনোত্তর মিয়ানমারের প্রথম বেসামরিক সরকারের প্রধান অং সান সু চি তাঁর দেশের সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হচ্ছেন। ২০১৭ সালের আগস্টে শুরু হওয়া রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযানের পর সু চি জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক ফোরামে খুব কমই অংশ নিয়েছেন।
সু চির বিরুদ্ধে সর্বজনীন এখতিয়ার নীতির আলোকে নেদারল্যান্ডসে মামলা হয়েছে বলে শোনা গেলেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই নীতির আলোকে মামলায় নেদারল্যান্ডসে গত সেপ্টেম্বরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে একজন সিরীয় বিদ্রোহী নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে সরকারপ্রধান হিসেবে সু চি দায়মুক্তির অধিকারী হওয়ায় তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা নেই বলেই ধারণা করা হয়। আর্জেন্টিনায় তাঁর বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের দপ্তরের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, আইসিজেতে গণহত্যার মামলার শুনানিতে অংশ নিতে অং সান সু চি এরই মধ্যে নেদারল্যান্ডসে পৌঁছেছেন।
গাম্বিয়ার পক্ষে মামলায় প্রতিনিধিত্ব করবেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তামবাদুর সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডসসহ বেশ কয়েকজন বিশ্ব পরিসরে নেতৃস্থানীয় আইনজ্ঞের শুনানিতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। আজ আদালতে গাম্বিয়া তার বক্তব্য উপস্থাপন করবে এবং কাল বুধবার মিয়ানমার তার অবস্থান তুলে ধরবে। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে গাম্বিয়া এবং বিকেলে মিয়ানমার প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন ও চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করবে। মামলার রায় পেতে স্বল্পতম আট সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলায় তিন দিনের শুনানি আজ শুরু।
মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সাবেক বার্তা সম্পাদক ল্যারি জ্যাগান গতকাল ব্যাংকক পোস্ট-এ এক নিবন্ধে লিখেছেন, আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের আইনি দলের প্রধান হিসেবে যুক্ত হয়েছেন গণহত্যা ও আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ কানাডার মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী অধ্যাপক উইলিয়াম সাবাস। মিয়ানমারের অ্যাটর্নি জেনারেল তুন তুন ও, দুই জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক দুই আইনজীবী যুক্ত আছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলে।
আইসিজেতে এই শুনানি উপলক্ষে এবং দ্য হেগ শহরে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার ছাড়াও অন্য কয়েকটি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা হাজির হয়েছেন। এসব দেশের মধ্যে আছে বাংলাদেশ ও কানাডা। মামলায় গাম্বিয়াকে সমর্থন দিতে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) কূটনীতিকেরাও উপস্থিত হয়েছেন। আরও জড়ো হয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী এবং মিয়ানমার সরকারের সমর্থকেরা। আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘটার আশঙ্কা থাকায় পুলিশের জোরালো নিরাপত্তা আশা করা হচ্ছে।
আদালতে গত ১১ নভেম্বর পেশ করা আবেদনে গাম্বিয়া বলেছে, কথিত শুদ্ধি অভিযানের সময় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল গোষ্ঠীগতভাবে অথবা আংশিকভাবে রোহিঙ্গাদের ধ্বংসসাধন। এ জন্য পাইকারি হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা, কখনো কখনো বাড়িতে লোকজনকে আটকে রেখে জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে গ্রামগুলোর পদ্ধতিগত ধ্বংস সাধন করা হয়েছে। গাম্বিয়া গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ৩ নম্বর ধারার আলোকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার উভয় দেশই ১৯৪৮ সালে গৃহীত এই সনদে স্বাক্ষরকারী এবং ওই ধারায় সনদ লঙ্ঘনবিষয়ক বিরোধ আইসিজেতে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। গাম্বিয়া সনদ লঙ্ঘনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি নিরসনে গত ১১ অক্টোবর মিয়ানমারকে কূটনৈতিকভাবে চিঠি দেয়।
আইসিজের নবনিযুক্ত রেজিস্ট্রার ফিলিপ গটিয়ে সম্প্রতি ইউএন রেডিওকে বলেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত হচ্ছে জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠান এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি। এই আদালতে রাষ্ট্র ছাড়া কেউ অভিযোগ করতে পারে না। বিরোধে লিপ্ত উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া আদালত কোনো বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন না। মামলার শুনানিতে মিয়ানমারের অংশগ্রহণকে তাই আইন বিশেষজ্ঞরা আদালতের প্রতি দেশটির আস্থার বহিঃপ্রকাশ বিবেচনা করে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কিছু অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ারও আবেদন জানিয়েছে গাম্বিয়া। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ রাখা এবং গণহত্যার সব ধরনের আলামত নষ্ট না করা।
রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচারে গাম্বিয়াকে সব ধরনের সহযোগিতা আর সমর্থন দেবে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। আইসিজেতে বিচারের শুনানি শুরুর আগে দুই দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে এ ঘোষণা দিল। দুই দেশের পক্ষে অটোয়া থেকে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত সোমবার বিবৃতিটি প্রচার করেছে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক জবাবদিহি সমুন্নত রাখা এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি রোধ করতে দুই দেশ যৌথভাবে গাম্বিয়ার উদ্যোগে অব্যাহতভাবে সমর্থন ও সহায়তা দিতে সম্ভাব্য সব উপায় খুঁজে দেখবে।
১৫ সদস্যের আদালত
এই আদালতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন সোমালিয়ার বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট চীনের বিচারপতি ঝু হানকিন। বিচারকদের নির্বাচন করেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ। অন্য সদস্যরা হলেন স্লোভাকিয়ার বিচারপতি পিটার টমকা, ফ্রান্সের বিচারপতি রনি আব্রাহাম, মরক্কোর মোহাম্মদ বেনুনা, ব্রাজিলের অ্যান্টোনিও অগাস্টো কানকাডো ত্রিনাদে, যুক্তরাষ্ট্রের জোয়ান ই ডনোহু, ইতালির গর্জিও গাজা, উগান্ডার জুলিয়া সেবুটিন্দে, ভারতের দলভির ভান্ডারি, জ্যামাইকার প্যাট্রিক লিপটন রবিনসন, অস্ট্রেলিয়ার রির্চাড ক্রর্ফোড, রাশিয়ার কিরিল গিভরগিয়ান, লেবাননের নওয়াফ সালাম এবং জাপানের ইউজি ইওয়াসাওয়া।