ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসেব করলে দুই বছর দুই দিন আগের কথা; মানে ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর। স্থান বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রাণকেন্দ্র মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের বিসিবি ভবনের নিচতলার লাউঞ্জ। ঘরোয়া ক্রিকেট কিংবা আন্তর্জাতিক আসর বা সিরিজ কিছুই ছিল না তখন।
এ রকম সময় ক্রিকেট সাংবাদিকরা যা করেন, সেদিন বিসিবির লাউঞ্জে বসে তাই হচ্ছিল। সাংবাদিকরা বসে গল্প করছেন। তবে সে দিনের খোশ গল্পর সাবজেক্ট বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, অবিসংবাদিত নেতা ‘মাশরাফি বিন মুর্তজা।’ দিনটি ছিল সে সময়ের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের জন্মদিন।
আগেই জানা মাশরাফি ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন না। জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা তাকে টানে না। সরাসরি বললে জন্মদিনে হৈ হুল্লোর, কেক কাটা কিংবা আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ না তার। তারপরও নড়াইল এক্সপ্রেসের জন্মদিন বলে কথা। বিসিবির মিডিয়া লাউঞ্জে কেক আনা হল। মাশরাফিকে সে লাউঞ্জে আসার আমন্ত্রণও জানানো হল। সঙ্গে জাতীয় দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনও থাকলেন আমন্ত্রিত।
সাংবাদিকদের চিন্তা ভাবনা ছিল এরকম, মাশরাফি বাসায় নিজে উদ্যোগি হয়ে আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন না। কিন্তু এ কেক তো আর তার আনা না। সাংবাদিকরা তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে এনেছেন। মাশরাফি তা ছুড়ি দিয়ে কাটবেন। একটা অন্যরকম পরিবেশ হবে।
অগ্রজপ্রতিম খালেদ মাহমুদ সুজনকে সঙ্গে নিয়ে মাশরাফি লাউঞ্জে এলেন। বসলেন। কেক দেখলেন। যেই তা কাটার কথা বলা হল, তখনই রাজ্যের আপত্তি। ‘না না ভাই আমি তো কেক কাটি না। জন্মদিনে কোন রকম আনন্দ উল্লাস, হৈ চৈ কেক কাটা কিংবা ভুরিভোজ কিছুই আমাকে টানে না। আমি ওসব করিনে।’
ঠিক আছে মানা গেল। কিন্তু এই কেক তো আর আপনি আনেননি। এটা সাংবাদিকরা এনেছেন। আপনি কাটুন আমরা সবাই মিলে মজা করে খাই। কিন্তু মাশরাফি অনঢ়। না ভাই। আমি কেক কাটিনে। কাটবোও না। আসলে জন্মদিন মানেই হৈ চৈ, কেক কাটা এসব আমার ভাল লাগে না। আমি জন্মদিনে কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করি না। আমার বাসায় জন্মদিনে কখনই কেক কাটা হয় না। কোনরকম আনন্দ, উল্লাস বা উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজনও করি না।’
কি আর করা? অগত্যা মাশরাফির জন্মদিন উপলক্ষে আনা কেক কাটলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। মাশরাফি বসে থাকলেন পাশে। এটুকু শুনে নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, তবে কি মাশরাফি সে কেকও মুখে দেননি? নাহ, তা দিয়েছেন। তবে সেটাও যেন ‘অনুরোধে ঢেকি গেলার’ মত। দুই সিনিয়র সাংবাদিক তার মুখে কাটা কেকের টুকরো তুলে দিলে মাশরাফি তা মুখে পুরে নেন।
কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যতিক্রমি চরিত্র, সব সময়ের সেরা অধিনায়ক ও ইনজুরিকে জয় করা এ লড়াকু ক্রিকেট সেনাপতির জন্মদিনের দিনই জন্ম হয়েছে একমাত্র ছেলে সাহিলের। পিতা ও পুত্রের একই দিনে জন্ম! খুব একটা দেখা দেয় না।
এই তো ৪৮ ঘন্টা আগে পেড়িয়ে গেল পিতা মাশরাফি বিন মুর্তজা আর ছেলে সাহিলের জন্মদিন। ভাবছেন, নিজের জন্মদিন ঘটা করে পালন না করলেও পিতা মাশরাফি নিশ্চয়ই ছেলের জন্মদিন ঠিক ঘটা করে পালন করেছেন। নাহ, সেটাও সে অর্থে পালিত হয়নি। মাশরাফি নিজে কেক আনেননি। তবে আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই কেক এনেছিলেন। তা খাওয়া হয়েছে। কিন্তু কাটা হয়নি।
কেন জন্মদিনে উৎসব না করা? ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন সবাই। মাশরাফি কেন ব্যতিক্রম? তার জীবনে কি জন্মদিনে কোন নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছিল? নাকি কোন প্রিয়জনের বিয়োগ ঘটেছিল? ভক্তদের নানা কৌতুহল। দক্ষিণ আফ্রিকা যাবার আগে সে সব কথাই জানিয়েছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। প্রশ্ন ছিল জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকতা করে সবাই। আপনি করেন না। নিজের তো না ই ছেলের জন্মদিনটাও ঘটা করে পালিত হয় না আপনার বাসায়। কেন?
জবাবে মাশরাফি অনেক কথাই বলেছেন। তবে সারমর্ম হলো জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকতা না করার চিন্তাটা মূলত তার মার। তিনি নিজেও তা লালন করেন। সে অর্থে ঘটা করে জন্মদিন পালন না করা, কেক না কাটা তাদের পারিবারিক সংস্কার। আসলে মাশরাফির পরিবারের কাছে জন্মদিনের সংজ্ঞা ভিন্ন। তারা এ দিনটাকে উৎসব, আনন্দ করার চেয়ে বরং সৃষ্টি কর্তার কাছে দোয়া চাইতেই বেশি পছন্দ করেন।
মাশরাফির মা এবং তার নিজের জন্মদিন দর্শন এ রকম, জন্মদিন আসলে মানুষের জীবন থেকে একটি বছর চলে যাবার বা জীবন থেকে এক বছর কমে যাবার দিন। সে দিন উৎসব, আনন্দ করা আর হৈ চৈ করে কেক কাটাকাটির চেয়ে সৃষ্টি কর্তার কাছে দেয়া চাওয়া উত্তম।
তবে বিনয়ী মাশরাফি জন্মদিন নিয়ে এই দর্শন ও মত কিন্তু আর কারও ওপর চাপিয়ে দিতে নারাজ। নিজে জন্মদিনে আনুষ্ঠানিকতা না করলেও যারা ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন, কেক কাটেন, হৈ হুল্লোর করেন তাদের সম্পর্কে নড়াইল এক্সপ্রেসের মন্তব্য, ‘যারা জন্মদিন ঘটা করে পালন করেন, আনুষ্ঠানিককতায় কাটান, কেক কাটেন, আনন্দ-উল্লাস করেন, তারা যে অন্যায় করেন এমন নয়। এটা যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছে। অভিরুচি। মানসকিতা। আমরা মনে করি জন্মদিন মানে প্রত্যেকের জীবন থেকে একটি বছর কমে যাওয়া। এ দিন কেক কাটার চেয়ে বরং আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে দোয়া চাওয়াকেই আমি ভাল বলে মনে করি।
আমাদের বাসায় সেটাই হয়। এবারো আত্মীয় পরিজনদের প্রায় সবাই আসছে। অনেকেই কেক টেক নিয়েও আসছে। তবে আমি তো আর কেক কাটি না। এমন কি আমার ছেলে সাহিলও কেক কাটেনি। কেক কাটাকাটি হয়নি। তাই যারা কেক এনেছিলেন, সেই কেক গুলো ঘরেই ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে কেক কাটা না হলেও পরে সবাই মিলে খাওয়া হয়েছে।’
জন্মদিনে কেক না কাটা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘আসলে কে কত দিন বাঁচবেন, কার আয়ু কত দিন? তা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন আগেই ঠিক করে রেখেছেন। ধরা যাক, একজন ৭০ বছর বাঁচবে। তাহলে জন্মদিন মানে তার জীবন থেকে এক বছর কমে যাওয়া। এ দিন হৈ চৈ করে কাটানোর চেয়ে সৃষ্টি কর্তার দয়া, কৃপা ও করুনা কামনা করাকেই আমি উত্তম মনে করি। আমাদের বাসায় সব সময়, জন্মদিনে দোয়ার আয়োজন হতো। এখনো হয়। আমরা সবাই মিলে যার জন্মদিন তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাই। এবার আমার ছেলে সাহিলের জন্যও দোয়া প্রার্থনা করা হয়েছে।’
শুধু জন্মদিনের বিষয়েই নয়, জীবন বোধ ও দর্শন একেক জনের একেক রকম। মাশরাফিকে যারা মাঠে দেখেন কিংবা টিভির পর্দায় ক্রিকেটার তার পারফরমেন্স দেখেন, তারা হয়তো জানেন না বাংলাদেশের ক্রিকেটের মাশরাফির দর্শন সত্যিই ভিন্ন। মাশরাফিকে যারা খুব কাছ থেকে দেখেন, তারা জানেন মাঠের ‘সিংহ পুরুষ’ মাশরাফি ব্যক্তি জীবনে বিনয়ের আধার। নম্রতা ও সৌজন্যতার প্রতিক। স্রষ্টার প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল। বিশ্বাসও প্রবল। তাই তো তার জন্মদিন দর্শনটাও অন্যদের চেয়ে আলাদা। সূত্র- জাগোনিউজ
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, ০৭ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ