কক্সবাজারে তীব্র দাবদাহেই লবণ উৎপাদনে রেকর্ড

কক্সবাজারে তীব্র দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। গরমের তীব্রতায় অনেক ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু এ গরমেই চাষিরা দৈনিক রেকর্ড পরিমাণ লবণ তুলছেন। দেশীয় স্বয়ংসম্পন্ন শিল্প লবণের চলতি বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তোড়জোড় চালাচ্ছেন লবণ চাষিরা। ৩৫-৩৮ ডিগ্রি গরম উপেক্ষা করে উপকূলের অর্ধলক্ষাধিক একরের বেশি মাঠে দৈনিক রেকর্ড ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হওয়ায় মহাখুশি ৪০ হাজারের বেশি প্রান্তিক চাষি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, গত কয়েক দিন দৈনিক ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। গত মৌসুমে এ সময়ে দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৩০ হাজার মেট্রিক টন। এবার মৌসুমের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন হয়েছে গত তিন-চার দিন।

চাষিরা বলছেন, আগামী ২০-২৫ দিন এমন অবস্থা বিরাজ করলে ৭-৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ (দৈনিক ৩০-৩৫ হাজার টন ধরে) উত্পাদন সম্ভব হবে। চলতি মৌসুমে আগের পাঁচ মাসে উত্পাদন হয়েছে আরো ১৬ লাখ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে এবারের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন সম্ভব হবে। কিন্তু কোনো কারণে কালবৈশাখীর তান্ডব কিংবা ঝোড়ো বৃষ্টি হলে লবণ উত্পাদন ব্যাহত হবে। এক দিনের বৃষ্টিতে প্রায় এক সপ্তাহ লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। তখন লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সহজতর হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে।

বিসিকের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৬ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এসব জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও একটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। তখন লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হবে। গত সোমবার কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, ঈদগাঁওর গোমাতলী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। চাষিরা মাঠের ওপর কালো পলিথিন বিছিয়ে সমুদ্রের লোনাপানি জমিয়ে তপ্ত রোদে শুকিয়ে লবণে পরিণত হচ্ছে লোনাপানি। কিছু চাষি মাঠে উৎপাদিত লবণ নিরাপদে স্তূপ করে মজুত করছেন। আবার অনেকে গাড়িতে করে সরবরাহ করছেন কারখানায়।

কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, টেকনাফ, চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন উপকূলে চলতি সপ্তাহ জুড়ে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪৬০ টাকায়। পরিবহন ও ঘাটের টোল পরিশোধে মণপ্রতি খরচ পড়ে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এতে ৪০০ থেকে ৪০৫ টাকা মূল্য পাচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা। মণপ্রতি ৪০০ টাকা পেলে দৈনিক উৎপাদিত ৩০ হাজার মেট্রিক টন লবণের দাম উঠছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

বিসিকের লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, আগামী ১৫ মে পর্যন্ত লবণ উত্পাদনের মৌসুম। প্রতি বছর এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কালবৈশাখী ও ঝোড়ো বৃষ্টি দেখা দেয়। এতে সাত-আট দিন লবণ উত্পাদন বন্ধ থাকে। এবারও তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

ঈদগাঁওর গোমাতলীর লবণচাষি রিদুয়ানুল হক বলেন, গত ২ এপ্রিল হঠাত্ ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হলে টানা পাঁচ-ছয় দিন লবণ উত্পাদন বন্ধ ছিল। ৭ এপ্রিল থেকে পুরোদমে লবণ উত্পাদন চলছে। এর আগে ২০ মার্চের ঝোড়ো বৃষ্টিতেও চার-পাঁচ দিন লবণ উত্পাদন বন্ধ ছিল। এখন যেভাবে চলছে তা বিদ্যমান থাকলে চাষিরা লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা রাখছি।

কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল রাস্তারপাড়ার চাষি বেলাল উদ্দিন (৩৫) ও চৌফলদন্ডীর চাষি আবছার কামাল (৪০) বলেন, লবণের বাম্পার উত্পাদন হচ্ছে। দুই-তিন দিন পরপর লবণ উঠানো যাচ্ছে। পুরোনো রেকর্ড মতে, এপ্রিলের শেষ সময়ে বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর এবারও তেমনটি তথ্য দিয়েছে। তাই লিজ ও বর্গা নিয়ে মাঠে নামা চাষিদের মনে শান্তি নেই। ঝোড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে লবণ চাষের মারাত্মক ক্ষতি হবে।

চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড (চৌফলদন্ডী বাজার এলাকার) মেম্বার (সদস্য) নাছির উদ্দিন (৪৫) বলেন, মৌসুমের মাঝখানে ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উত্পাদনের খরচ বেড়ে যায়। তবে, সে মতে লবণের দাম বাড়ে না। বর্তমানে মাঠে উৎপাদিত প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০-৪৬০ টকায়। পরিবহন ও টোলসহ অন্যান্য খরচ বাদে মিলছে ৪০০ টাকা। কিন্তু মণপ্রতি লবণ উৎপাদনে, শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ব্যয় ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এতে মূল চাষিরা লাভবান হয় না। তবে, ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা লবণের দাম নিয়মিত থাকলে লবণচাষিরা লাভবান হবেন, চাষাবাদও বাড়বে।

বাংলাদেশ লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি ও মহেশখালীর লবণচাষি আনোয়ার পাশা চৌধুরী জানান, লবণের দাম একটি সিন্ডিকেটের কব্জায় জিম্মি। তারা-ই লবণের দাম একেক সময় একেক রকম নির্ধারণ করে। মৌসুমের শুরুতে গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ৫০০ টাকা মণ লবণ বিক্রি হয়েছে। ন্যায্য দাম পাচ্ছে দেখে কয়েক বছর চাষ ছেড়ে দেওয়া অনেকে আগ্রহ নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাত্ প্রতি মণ লবণের দাম এসে দাঁড়ায় ২৫০-৩০০ টাকায়। লবণ বিক্রি বন্ধ ও প্রশাসনিক যোগাযোগের পর মার্চে ৩২০-৩৭০ টাকা, আর এখন ৪৫০-৪৬০ টাকা লবণ বিক্রি করে পাচ্ছে চাষিরা। চাষিদের দাবি ছিল, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম পুরো মৌসুম জুড়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণ থাকুক।

লবণ উত্পাদনের সঙ্গে জড়িত কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লবণ আমদানি বন্ধ রেখে মাঠপর্যায়ে চাষিদের সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় লবণ বেচাবিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেও ৫০০ টাকায় লবণ বিক্রি হয়েছে। পরবর্তীকালে সিন্ডিকেট দাম সর্বনিম্ন ২৫০ টাকায় কমিয়ে আনে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, নিজস্ব উৎপাদনে দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম এক মাত্র দেশীয় শিল্প পণ্য হলো লবণ। উত্পাদনের ধারাবাহিকতা বহমান রাখতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি।