বিমান ছিনতাইকে কেন্দ্র করে এখনও পর্যন্ত গোয়েন্দারা খুঁজে ফিরছেন নানা উত্তর। কেন ছিনতাই, নেপথ্যে কাদের সম্পৃক্ততা, ফায়দা কি এমন হাজারটা প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে আবার বিমান বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইছেন।
২৪ তারিখ সন্ধ্যে ৫.৩০ মিনিটে দুবাইগামী ময়ূরপঙ্খী নামক বিমানটি ছিনতাইয়ের প্রচেষ্টা হয়। বিমানটি ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা। কিন্তু উড্ডয়নের ক্ষণকাল পরেই একজন ছিনতাইকারী পিস্তল ধরে তাঁর কথিত স্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করে বিমানের পাইলট আর কেবিন ক্রুদের জিম্মি করেন। বিমান ছিনতাইয়ের পুরো ঘটনাটি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করলে অন্য কারো সম্পৃক্ততা আছে বলে এখন পর্যন্ত কোন তথ্য পাওয়া যায় না, তবে কি কেবল মাহাদির একারই উর্বর মস্তিষ্কের ফল!
২৬-২৭ বছর বয়সী পলাশ আহমেদ ওরফে মাহাদি ওরফে মাহাবি জাহান মনে হয় ‘রাখাল বালকের বাঘ এলো বাঘ এলো’ গল্পটি শুনেননি। তাই একটু বড় হওয়ার পর থেকে একটির পর একটি মিথ্যা গল্প ফেঁদে গেছেন। তিনি জানতেন না মিথ্যার উপর ভর করে সুন্দর কোন স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই কখনো ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজে চাকরি, কখনো ব্রিটিশ সিটিজেন, কখনো দুবাইয়ের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে চেয়েছেন।
অল্প বয়সী ছেলেদের হাতে কাঁচা পয়সা এলে যা হয় তাঁর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সিনেমার প্রডিউসার হতে চেয়েছেন। সিনেমার রঙিন জগতের গ্ল্যামারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজের থেকে ২০ বছরের বড় সিমলাকে বিয়ে করেছেন।
নায়িকা সিমলা যখন বুঝতে পেরেছেন পুরোটাই মিথ্যে, সেই জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেননি। কিন্তু মাহাদি তা মেনে নিতে নারাজ। কেবল নায়িকা সিমলাই নন, ২০১২ সালে সোনারগাঁয়ে ১৭ বছরের মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্বীকৃতি না পেলে ২০১৪ সালে বগুড়া সদর উপজেলার মেঘনা নামে অপর এক মেয়ের সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, সেই ঘরে আয়ান নামক আড়াই বছর বয়সী এক পুত্র সন্তান রয়ে গেছে।
পয়সার সাথে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর কৃষ্টির মিল না হলে সেই গরম সহ্য করা অনেকের জন্যই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত পলাশ সিমলাকে হারিয়ে চারিদিকে অন্ধকার দেখছিলেন, কারণ রঙ্গিন স্বপ্নের একমাত্র অর্জন ছিল সিমলা।
অনেকেই পলাশকে অতিরিক্ত বিষাদে মানসিক বৈকল্য, বিকারগ্রস্থ হিসেবে কল্পনা করতে চাইছেন, ভাবতে চাইছেন নিজের স্ত্রীকে পাওয়ার জন্য কেবলই এই ব্যাকুলতা, উন্মাদনা। তাছাড়া শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আসল পিস্তল হলে ধরা পড়তো অনেক আগেই। ফেইক প্লাস্টিকের খেলনা পিস্তল বলে কেবল আকৃতি দেখে হয়তো কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। এরকম খেলনা পিস্তল দিয়ে ছোট বাচ্চারা কতোই তো খেলা করে।
মাহাবি জামান নামে ফেসবুক খুলে মিথ্যা তথ্যের আড়ালে পলাশ আহমেদ কতো মানুষকেই হয়তো ধোঁকা দিয়েছে। এবারো শেষ চাল হিসেবে নকল পিস্তল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ই নিতে চেয়েছেন। কিন্তু বিঁধি বাম এবার আর শেষ রক্ষা হলো না।
দুবাইগামী বিমান দেশী এবং বিদেশী লোকজনে ঠাঁসা। পাইলট আর কেবিন ক্রুরা নিজেকে এবং যাত্রীদের জীবন রক্ষা করতে ভীষণভাবে শঙ্কিত, ব্যতিব্যস্ত। আমাদের দেশে গুলশানের হলি আর্টিজেনের নির্মম ঘটনার পর রিস্ক নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। জঙ্গি আতংক জুজুর ভয়ের মতো সবার মানসপটে চিরদিনের জন্য আঁকা হয়ে গেছে। পিস্তল প্লাস্টিক খেলনা নাকি অরিজিনাল সেটি ভাবার সময় নেই। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্তৃক ৮ মিনিটের কমান্ডো অভিযানে নিজের মৃত্যু পলাশ স্বয়ং নিজে রচনা করেছেন। আমাদের দেশে ময়ূরের পুচ্ছধারী পলাশদের কোন কমতি নেই, এই ঘটনাটির এমন পরিসমাপ্তি না ঘটলে মজনুরুপী অন্য পলাশরা অনুপ্রাণিত হয়ে আরও ভয়ঙ্কর কোন ঘটনার জন্ম দিতে পারতো।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাঁটা গ্রামের মুদী দোকানী পেয়ার আহমেদের একমাত্র ছেলের অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য ক্ষমতাতিরিক্ত স্বপ্নই তাঁর কাল হল। প্রমাণ করে গেল, ‘মিথ্যাকে আশ্রয় করে কোন কিছু জয় করা সম্ভব নয় কিছুতেই’।
লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি নিউজ