বিএনপির আদর্শিক জোট ২০ দল। তাদের মূল আদর্শিক সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। শুধু আদর্শের সঙ্গীই নয়, জামায়াতে ইসলামীই বিএনপির জোটসঙ্গী এবং ভোটসঙ্গীও। জামায়াতের ভোট ব্যাংকে পুজি করেই ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি। তাই সেই মজাটা তারা ভুলতে পারেনি। সেই থেকে দেশী-বিদেশী নানামুখী সমালোচনা সত্বেও জামায়াতকে ছাড়েনি বিএনপি। ছাড়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। বরং যত দিন যাচ্ছে, তাদের প্রেম আরো কঠিন হচ্ছে।
বিএনপির যেমন জামায়াতকে দরকার, তেমনি নিবন্ধন হারানো জামায়াতেরও বিএনপি ছাড়া গতি নেই। বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ থাকার সুযোগেই জামায়াতের ২২ জন ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছিল। নইলে এবার জামায়াতকে রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে হতো। অবশ্য নির্বাচনে যে ফল করেছে, তাতে জামায়াত শুধু নয়, বিএনপিরও রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘোরার দশা।
জামায়াতের সাথে জোটের সুবিধাটা যেমন বিএনপি জানে, অসুবিধাটাও জানে। জামায়াতের সাথে জোট করার কারণে বিএনপিকে বছরের পর বছর গালি শুনতে হয়েছে। সেই গালির গ্লানি থেকে মুক্তি পেতেই নির্বাচনের আগে তারা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়। বিএনপি জানে জামায়াতের কিছু ভোট আছে, কিন্তু ভাবমূর্তি নেই। আর ঐক্যফ্রন্টের ভাবমূর্তি আছে, ভোট নাই। বিএনপি চাতুর্য্যের সঙ্গে ভোট এবং ভাবমূর্তি দুটিই রক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু অতি চালাকের যেমন গলায় দড়ি পড়ে, বিএনপিরও তেমনি এ কূল ও কূল দু কূলই গেছে। বিএনপি এখন অকূল পাথারে।
জামায়াতের সাথে বিএনপির আদর্শিক নৈকট্য থাকলেও, ঐক্যফ্রন্টের সাথে ছিল যোজন যোজন ফারাক। বিপদে পড়লে মানুষ যেমন চিরতার পানি খায়, বিএনপিকেও তেমনি নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা শুনতে হয়েছে, জয়বাংলা স্লোগান শুনতে হয়েছে।
ড. কামাল হোসেন স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে কোনো ঐক্য না করার অঙ্গীকার করলেও বিএনপি কৌশলে তাদের ফাঁদে ফেলে জামায়াতের সাথে অভিন্ন প্রতীকে নির্বাচন করতে বাধ্য করে। ব্যাপারটা যে ড. কামালের পছন্দ হয়নি, নির্বাচনের দুদিন আগে সাক্ষাতকার দিয়ে তিনি সেটা বলেও দিয়েছিলেন। ড. কামাল বলেছিলেন, জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হবে জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের দায়িত্ব নিতেন না। বেশ ধরলেই যেমন কাক ময়ুর হতে পারে না, বিএনপিরও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সাজা হয়নি। জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার পর নতুন প্রজন্মের ভোট আর পায়নি ঐক্যফ্রন্ট।
শুধু নির্বাচনের আগে নয়, পরেও বিএনপির জামায়াতসংশ্লিষ্টতা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন ড. কামাল। তিনি বলে দিয়েছেন, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলবেন তিনি। এখন বিএনপির সামনে প্রশ্ন, তারা জামায়াত ছাড়বে না ঐক্যফ্রন্ট? নির্বাচনের প্রবল ভরাডুবির পর বিএনপির তৃণমূলে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে তীব্র ক্ষোভ। ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে ২০ দলকে নিয়ে সামনে এগোনোর চাপ বাড়ছে।
বিএনপি কী করবে খোলাসা করে এখনও বলেনি। তবে ঐক্যফ্রন্টের ভেঙ্গে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। ঐক্যফ্রন্টের সর্বশেষ বৈঠকে যোগ দেননি বিএনপির কেউ। অসুস্থতা বা ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে গেছেন সবাই। এসবই যে অজুহাত, তা বুঝতে কাউকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে হয় না। অক্টোবরে গড়া ঐক্যফ্রন্ট তাই জানুয়ারিতে রাজনীতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।
সমস্যাটা হলো তেলে জলে যে কখনো মেশে না, এটা ড. কামাল বা মির্জা ফখরুল জানলেও মানতে চাননি। বিএনপির সাথে ঐক্যফ্রন্টের বাকি দলগুলোর আদর্শের কোনো মিল নেই। গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডি- সবগুলো দলই আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গড়া। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানেন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন চায়। কিন্তু বিএনপি এর কোনোটাই বিশ্বাস করে না। তাই ড. কামালের ভাবমূর্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বিএনপির স্বপ্নভঙ্গ হতেও দেরি হয়নি।
এতদিন ঐক্যফ্রন্ট সহ্য না করলেও বিএনপি এখন কেন তাদের সাথে থাকবে? তবে আমার ধারণা, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ১৩ অক্টোবর গঠিত হলেও ঐক্যফ্রন্ট বাতাসে মিলিয়ে যাবে কোনো ঘোষণা ছাড়াই। ঐক্যফ্রন্টের জন্ম তারিখ থাকবে, মৃত্যর কোনো তারিখ থাকবে না। এর আগে ২০১৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া টানা ৯২ দিনের অবরোধ থেকে সরে গিয়েছিলেন কোনো ঘোষণা ছাড়াই।
বিএনপির ভেতরে যেমন ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার প্রবল চাপ আছে। ঐক্যফ্রন্টের ভেতরেও চাপ আছে বিএনপি ছাড়ার। নির্বাচনে ৬টি আসন পাওয়া বিএনপির জন্য মহাবিপর্যয় হলেও গঠনের ২৬ বছর পর প্রথম দুটি আসন নিয়ে সংসদে যাওয়ার সুযোগ গণফোরামের জন্য বিশাল বিজয়। বিএনপি শিবিরে যখন শোকের ছায়া, তখন নির্বাচনের পর গণফোরামের প্রথম বর্ধিত সভায় ছিল উৎসবের আবহ। সে সভায় গণফোরামের দুই এমপির শপথের সিদ্ধান্ত হলেও পরে বিএনপির চাপে তারা পিছিয়ে এসেছে। তবে আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত গণফোরামের দুই এমপি শপথও নেবেন, সংসদেও যাবেন। বিএনপি যদি ঐক্যফ্রন্টের সভায় যোগ না দেয়, তাহলে আর তাদের দাবি গণফোরামকে মানতে হবে কেন।
ঐক্যফ্রন্টে যে ঐক্য নেই, বিএনপি আর গণফোরামে যে ঐক্য হবে না; তা এর উদ্যোক্তারা জানতেন। তাই তারা জোটের নামই রেখেছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নামে যদি কাজ হয়। কিন্তু স্বার্থে কিছুটা মিললেও আদর্শে না মেলায় ঐক্যফ্রন্টের অপমৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।