এবনে গোলাম সামাদ
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি যুদ্ধ চান না। কিন্তু তিনি না চাইলেই যে যুদ্ধ হবে না, এমন নয়। বাংলাদেশের একটা সেনাবাহিনী আছে, আমাদের সীমান্ত আক্রান্ত হতে পারে বলেই আমরা গড়ে তুলেছি আমাদের সেনাবাহিনীকে। যুদ্ধ ভয়ঙ্কর ঘটনা। কিন্তু পৃথিবীতে এখনো যুদ্ধ হচ্ছে। আর মনে হয় আরো যুদ্ধ হবে। একটি সমাজবিজ্ঞানের বইতে পড়েছিলাম, দু’টি যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কে শান্তি বলে। আরাকানে এখন যা ঘটছে, তার জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। দায়ী মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং উগ্র থেরাবাদী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ। রোহিঙ্গারা আরাকানে বহুদিন হলো বাস করছেন। তারা সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ নন।
যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী আমাদের দেশে আসছেন, তাদের বেশির ভাগই হলেন নারী। আর তাদের সঙ্গে আসছে তাদের সন্তানেরা। তাদের বয়স এতই অল্প যে, সহজেই অনুমান করা চলে তারা জন্মেছে আরাকানে। তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তারা জন্মসূত্রে হলো আরাকানের নাগরিক। কিন্তু মিয়ানমার চাচ্ছে না এই সাধারণ আন্তর্জাতিক আইনকে মান্যতা দিতে। তারা বলছে, এরা সবাই নাকি হলো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, মিয়ানমার এত লোককে সে দেশে যেতে বাধা দেয়নি কেন। বাংলাদেশ থেকে এত লোক হঠাৎ করে আরাকানে যেতে পারল কিভাবে? ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানে যে লোক গণনা হয়, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সে সময়ে আরাকানের মোট জনসমষ্টির শতকরা ৩৬ ভাগ হলো মুসলমান।
আমরা যুদ্ধ না চাইলেও মিয়ানমার যুদ্ধ চাইতে পারে। কেননা, আমরা বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসকে যেভাবে দেখছি, মিয়ানমারের ম্রনমারা ইতিহাসকে সেভাবে দেখেন না। তারা মনে করেন, এক সময় মিয়ানমারের সীমানা ছিল কুমিল্লা পর্যন্ত। দক্ষিণ বর্মা বা নি¤œ মিয়ানমারের রাজা বোদবপায়া আরাকান জয় করেন ১৭৮৫ সালে। মনিপুর জয় করেন ১৮১৩ সালে। সাবেক আসাম জয় করেন ১৮১৬ সালে। এরপর তিনি ব্রিটিশ রাজকে ছেড়ে দিতে বলেন চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং মুর্শিদাবাদের অধিকারকে। হতে পারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চাচ্ছে রাজা বোদবপায়াকে অনুসরণ করতে। মিয়ানমারে জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে এক উগ্র ম্রনমা থেরাবাদী বৌদ্ধবাদ, যা হবে তাদের একটা বিরাট সাম্রাজ্য বিস্তারের আবেগগত হাতিয়ার।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি যুদ্ধ চান না। কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধান সেনাপতি বিপিন রাওয়ার বলেছেন, চীন ও পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধের আশঙ্কা হলো খুবই বাস্তব। তার মতে, ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের বিবাদের মীমাংসা নাকি শান্তিপূর্ণ উপায়ে হওয়া সম্ভব নয়। তিনি এসব কথা বলেছেন নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেনা সেমিনারে। তাই তার কথাকে গ্রহণ করা উচিত যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে।
অন্য দিকে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন বলছেন, তিনি হাইড্রোজেন বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করবেন। এরকম একটি বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যুদ্ধ না চাইলেই যুদ্ধ হবে না, এমন ভাবনা কবি-কল্পনা মাত্র। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, পূর্ব এশিয়ায় কোনো যুদ্ধ শুরু হলে তার ধাক্কা বাংলাদেশে এসে লাগতেই পারে। তাই বাংলাদেশকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমরা কি সেটা করছি? মিয়ানমারের সাথে আমাদের যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পেরেছে, ভারত তাতে পালন করছে খুবই সন্দেহজনক ভূমিকা। চীন ও রাশিয়া যে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলছে অথবা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাচ্ছে, তা মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশকে সমর্থন করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও কিছুটা পরিমাণে জার্মানি। অর্থাৎ পরিস্থিতি হয়ে উঠতে চাচ্ছে কিছুটা ঠাণ্ডা লাড়াইয়ের যুগেরই মতো।
তবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব নিয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ। যেটা খুবই আশাব্যঞ্জক। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যদি বাংলাদেশের পক্ষে থাকে, তবে বাংলাদেশ অন্য আর কোনো রাষ্ট্রের সাহায়তা ছাড়াও মিয়ানমারকে কাবু করতে পারবে। মালয়েশিয়ার সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের সাথে। সে যদি দক্ষিণ দিক থেকে মালয়েশিয়ার আক্রমণের শিকার হয়, তবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া তার পক্ষে মোটেও সহজ হবে না। আরাকানে পূর্ব দিকে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা ও ঘন বনভূমি। এই পর্বতমালার মধ্য দিয়ে আছে কয়েকটি গিরিপথ। কিন্তু এসব গিরিপথের মধ্য দিয়ে পদাতিক সৈন্য, সাঁজোয়া বহিনী, রণসম্ভার ও খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আসা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের সাথে আরাকানের যোগাযোগ এখনো চলেছে প্রধানত সমুদ্রপথে।
১৯৪২ সালে জাপান সমুদ্র পথে দক্ষিণ দিক থেকে এসে জয় করেছিল বর্মা। পরে ১৯৪৩ সালে বর্মার মূল ভূখণ্ড থেকে স্পিডবোটে করে এসে দখল করেছিল আরাকান। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল জাপানের অধীনে। ব্রিটেন আরাকান জয় করেছিল স্থলপথে সৈন্য পাঠিয়ে। আরাকান জয় করার পরে তারা আরাকান পর্বতমালার গিরিপথগুলোর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে গিয়ে আক্রমণ করেছিল জাপানিদের বর্মার মূল ভূখণ্ডে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনুরূপ রণকৌশল গ্রহণ করতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ আরাকানের মধ্যে কোনো পর্বত-প্রাচীর নেই। বাংলাদেশ থেকে পদাতিক সৈন্য ও সাঁজোয়া বাহিনী অনেক সহজে প্রবেশ করতে পারে আরাকানে। কিন্তু মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে আরাকানে সৈন্য, সামরিক সাজসরঞ্জাম আনা এখনো হয়ে আছে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভারতের ভূমিকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, ভারত বলছে না রোহিঙ্গারা আসলে আরাকানের নাগরিক এবং তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। যেমন বলছে গ্রেট ব্রিটেন ও বিশ্বের আরো অনেক রাষ্ট্র। মূল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গাদের আরাকানে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়ার কারণে। তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে না দিলে সমস্যার কোনো সমাধান যে হবে না, সেটা সহজেই অনুমান করা চলে।
ভারত এ ক্ষেত্রে পালন করছে সুবিধাবাদীর ভূমিকা। তাকে বিশ্বাস করা হবে বড় রকমের রাজনৈতিক ভুল। নরেন্দ্র মোদিকে এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন ইতোমধ্যেই কঠোর সমালোচনা। ভারতের সাথে বর্তমান আরাকানের কোনো সীমানা নেই। ভারতের অঙ্গরাজ্য মিজোরামের সাথে সীমানা আছে বর্তমান মিয়ানমারের চীন নামক স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের। যেখানে কোনো রোহিঙ্গা নেই। রোহিঙ্গারা আরাকান থেকে কিভাবে ভারতে যেতে পারছেন এবং সমস্যার সৃষ্টি করতে পারছেন, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও ভারত দাবি করছে, রোহিঙ্গারা নাকি তাদের জন্য হয়ে উঠেছেন সমস্যা। কিছু রোহিঙ্গা নাকি কাশ্মিরে গিয়ে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন ভারতের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের সাথে লাগোয়া হলো ভারতের মিজোরাম প্রদেশ। ১৯৬৬ সালে মিজোরা বিদ্রোহ করেছিলেন ভারত থেকে স্বাধীন হওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু তারা এই বিদ্রোহে সাফল্য পেতে পারেননি। বহু মিজো গেরিলা যোদ্ধা পালিয়ে এসেছিলেন তদানীন্তন পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামে। এ অঞ্চলে তেমন সঙ্ঘাত শুরু হলে মিজোরা নিতে পারেন বাংলাদেশেরই পক্ষ। মিজোরা হিন্দু নন। তারা অধিকাংশই হলেন এখন ব্যাপটিস্ট খ্রিষ্টান। তারা হলেন হিন্দুত্ববাদের বিশেষ পরিপন্থী।
অং সান সু চি বলছেন, তিনি আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার চান না। কিন্তু তিনি যদি তাদের নাগরিকত্ব না দেন, তবে রোহিঙ্গারা আরাকানে কখনোই বাস করতে পারবেন না। তাই আমরা তার মুখের কথায় আস্থা রাখতে পারি না। ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতারা অনেকেই সু চির ব্যক্তিগত বন্ধু। ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হতে পেরেছে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ফলে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হলে তাই তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। জেরেমি করবিন সু চির প্রতি রেখেছেন তার এই ব্যক্তিগত অনুরোধ। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী এরকম কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখেননি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে। যদিও দেশের বর্তমান ভারতবান্ধব সরকার বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্র হিসেবে ভারত আছে আমাদের পাশে।
বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৫০টি বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে চিঠি লিখেছেন। বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সহায়তা করতে। তার এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধু কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আসতে পারবে, তা মনে হচ্ছে না। যদিও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন যথেষ্ট আছে বিশ্ব জনমতকে পক্ষে পাওয়ার জন্য। আরাকান থেকে ১৯৯১ সালে ২৫০০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছিল। ১৯৯৪ সালে মিয়ানমার বলেছিল, তারা রোহিঙ্গাদের আরাকানে ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। এখন রোহিঙ্গা সমস্যা দেখা দিয়েছে আরো মারাত্মকভাবে। আওয়ামী লীগ সরকার বলছে, বিএনপি যা কিছু করছে, তা কেবলই লোক দেখানো। কিন্তু বিএনপি দেশের একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। তার আছে একটি পররাষ্ট্রনীতি। সে যা করছে, সেটা সে করছে তার পররাষ্ট্রনীতির ওপর নির্ভর করেই। একে উপহাস করার কিছু নেই।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ