খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন: অনেকে নানা জায়গায় দেখা হলে কায়দা করে প্রশ্ন করেন আমার লেখায় কেন শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন করি? ফেসবুক ইনবক্সেও কেউ আকার-ইঙ্গিতে, কেউ বা সরাসরি একই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কখনো হেসে এড়িয়ে যাই, কখনো বা বলি শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনা। তাই তাকে সমর্থন করে যাই। মাঝেমধ্যে গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি, কেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত সমর্থন করি! কেনই বা বিশ্বাস করি না যে, শেখ হাসিনার বিকল্প এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা ছাড়া কিছু নেই। পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান বলে? নাকি নিজে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুবাদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি গভীর আস্থা নিয়ে তার সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটায় এখনো পথ হারাতে পারিনি?
মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে। বয়স আর অভিজ্ঞতা আমাদেরও এখন অনেক হয়ে গেছে। জীবনকে বোঝার পাশাপাশি সমাজ, রাজনীতি, জগৎ-সংসার কম দেখা হয়নি। খারাপ মানুষ, ভালো মানুষ, খারাপ চিন্তা, ভালো চিন্তা, গণমুখী রাজনীতি, গণবিরোধী অপশক্তি, ভালো রাজনীতিবিদ, মন্দ রাজনীতিবিদ; এক কথায় গোটা সমাজচিত্রে বাস করা চরিত্রগুলো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো বা সমষ্টিগতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলেই মনের গভীর থেকে যার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য জন্মায়; তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
তার সরকারের প্রতি, তার অনেক মন্ত্রীর প্রতি কিংবা অনেক নেতাকর্মীর প্রতি অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলতে পারি, শেখ হাসিনার প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থন নিঃশর্ত। এই সমর্থন সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। মোটা দাগে, অল্প কথায় যদি চিত্রিত করি যুক্তির ওপর ভর করে, কেন আমি শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাকেই মনে করি। তাতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর ৪৬ বছরের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার একটি ছোটখাটো পোস্টমর্টেম হয়ে যায়। আমাদের রাজনীতি ৪৬ বছর ধরেই ব্যক্তিকে ঘিরে বা বলা যায় জনগণনির্ভর নেতৃত্বকে ঘিরে। সেখানে যৌথ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে ওঠেনি।
এমনি পরিস্থিতিতে যত শাসক এসেছেন, সেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাইরে রাখলে শেখ হাসিনাই শাসক হিসেবে উত্তম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আদর্শ, মূল্যবোধ ও গণমুখী আদর্শিক রাজনীতি চোরাবালিতেই ডুবে যায়নি, নির্লোভ রাজনীতির বিপরীতে গণবিরোধী, ক্ষমতালোভী, সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়েই ওঠেনি; স্বৈরশাসকদের ছায়ায় ভোগ-বিলাসের পথে রাজনীতিকে সহজলভ্য বিত্তবৈভব গড়ার সড়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষাক্ত বাতাসে সমাজ ও রাজনীতিকে আচ্ছন্নই করা হয়নি, উন্নয়নের স্লোগান তুলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করাই হয়নি, ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগণতান্ত্রিক শাসকরা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতে একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদেরও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন। প্রশাসনকেও শাসকের অঙ্গ হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে গণবিরোধী শক্তি হিসেবে তৈরি করেছিলেন।
স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে আসা শেখ হাসিনার সংগ্রাম ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। মৃত্যুভয়কে পায়ে পায়ে জয় করে জনগণকে পিতার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে সম্মোহনী শক্তিকে সংগঠিতই করেননি; আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে, নিরন্তর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন, ভাঙন ও হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে নিঃশেষ করার চেষ্টা হয়েছে, ২১ বছর পর তিনি সেই দলকে ব্যালট-বিপ্লবে ক্ষমতায় এনেছেন।
পৃথিবীর দেশে দেশে কি উন্নত, আধুনিক, কি অনুন্নত, পশ্চাৎপদ সব দেশেই রাষ্ট্রনায়োকচিত দক্ষ নেতৃত্বের গুণেই একেকটি রাষ্ট্র এগিয়েছে। তার ’৯৬ শাসনামল সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ শক্তিকে নিয়ে বিরোধী দলের জোট গঠনের পর শেখ হাসিনাই বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই করেননি, খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত করেছেন। অশান্ত উপমহাদেশের রাজনীতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে অভিভাবকত্বের জায়গায় শান্তির দূত হিসেবে বন্ধুত্বের হাতছানি ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে যুগের পর যুগ রক্তস্নাত পাহাড়িদের জীবনে শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে চরমপন্থিদের সুপথে ফিরিয়েছেন। সংসদে মন্ত্রীর বদলে এমপিদের স্থায়ী কমিটির সভাপতি, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালুর মধ্য দিয়ে সংসদকেই সব কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু করতে চেয়েছেন। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শেখ হাসিনা সুসংহতই করেননি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলের অভিজ্ঞ, বরেণ্য রাজনীতিবিদদের রেখে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচিত করেছেন। ১৯৯৮ সালের বন্যা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলাই করেননি, নারীর ক্ষমতায়নের দুয়ারই খুলে দেননি, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের দিগন্তও উন্মোচিত করেছিলেন।
তবুও ষড়যন্ত্র তার প্রতি সদয় হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে পরাস্ত করা হয়েছে। অনেক শক্তি নেপথ্যে একসঙ্গে কাজ করে ভোটযুদ্ধে তাকে পরাজিত করেছিল। তবুও তিনি দমে যাননি। তার নেতাকর্মীদের ওপর হত্যাযজ্ঞই চালানো হয়নি, জঙ্গিবাদের উত্থানই ঘটানো হয়নি, সন্ত্রাসবাদের কালো থাবা জনপ্রিয় নেতাদের জীবনই কেড়ে নেয়নি; তাকেও প্রকাশ্য দিবালোকে একুশের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। গোটা বাংলাদেশে অস্থির, অশান্ত, রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু যার ধমনিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত, সংগ্রাম যার বুকের ভেতর, দেশ ও মানুষ যার শক্তি তাকে দমায় কে? তিনি ফের ১৪ দল ও মহাজোট গঠন করে জনমত পক্ষে টেনে নিলেন।
একটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সব জনমত জরিপে তিনিই শীর্ষে থাকলেন। তবুও গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। কিন্তু আজকে যারা গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করছেন বা এদের সঙ্গে যারা গলা জড়াজড়ি করছেন তারা সবাই মিলে একটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইলেন। সেই পথ ধরে ওয়ান-ইলেভেন এসে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে ষড়যন্ত্রের পথে সরিয়ে দিতে চাইলেন। দলের অভ্যন্তরে একটি শক্তি সেই শক্তির সঙ্গে যুক্ত হলো। কিন্তু জনগণ ও কর্মী যার প্রতি আস্থাশীল সেই নেত্রী শেখ হাসিনাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরেছেন, সাহসিকতার সঙ্গে সেই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। কিন্তু নিজস্ব ক্যারিশমা, ইমেজ ও শক্তিতে পরাস্ত করে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
ব্যালট-বিপ্লবে গণরায় রায় নিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে দিনবদলের সনদ নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরেছেন। সাফাল্য তার হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। সমুদ্র বিজয়, সীমান্ত সমস্যার সমাধান, নিজস্ব অর্থনীতিকে বিশ্বমন্দার কবল থেকে রক্ষা করে জাতীয় প্রবৃদ্ধির সূচকই বাড়াননি, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ তার হাত ধরে আজকের এই বাংলাদেশ। তিনি গণতন্ত্রের পথে গেছেন। তার অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। একের পর এক সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচনে বিএনপির বিজয় প্রমাণ করেছে।
২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে ওয়াক ওভার দিয়েছে। শেখ হাসিনার সমঝোতা ও আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করেছে। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে রক্ষার হটকারী পথ নিয়েছে। এক পাল্লায় উঠে সহিংস হরতাল, অবরোধ, ভোট বর্জন, প্রতিরোধসহ নানামুখী নাশকতার কর্মসূচি নিয়ে নিজেদের পঙ্গু করেছে। যারা বলছেন সংসদ অকার্যকর, শক্তিশালী বিরোধী দল নেই, তাদের আঙুল প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্ত রাজনীতির অন্ধগলিতে পথহারা বিএনিপর দিকেই তোলা উচিত। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে ক্ষমতা নিশ্চিত নয়। ভোটযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণই বড় কথা।
শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতু করছেন। উন্নয়নের এক মহাকর্মযজ্ঞে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে। সুশাসন নিশ্চিত করা সামনে তার চ্যালেঞ্জ। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে দলে ও সংসদে যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতৃত্ব নির্বাচন, মনোনয়ন তার সমানে চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রের পথে যতটা না পরাস্ত করা গেছে, তার চেয়ে বেশি ষড়যন্ত্রের পথে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। বিশ্বমোড়লদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জীবন দিয়েছেন পরিবার-পরিজনসহ। কুড়িবারেরও বেশি শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে। তার রাজনীতি ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও যে হবে তা অবলীলায় বলা যায়।
কারণ বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটি ও মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। দেশপ্রেমই তার রাজনীতির মূল শক্তি, জনগণই তার ক্ষমতার উৎস। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের বাইরে তার রয়েছে আটপৌরে এক মানবিক কোমল হৃদয়। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় মানুষ, বিপদগ্রস্ত, নির্যাতিত কর্মী এক কথায় সাধারণের জন্য তার হৃদয় কেঁদে ওঠে। গভীর মমতায় কাছে টানে। অনাথের বিয়ে দেন, জীবনের নিরাপত্তা দেন। তিনি মানুষের কল্যাণে রাজনীতির পথে হাঁটেন। শেখ হাসিনাই আজকের দুনিয়ায় মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার হিসেবে আলোর বাতিঘর হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করেছেন। তাই শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। আর এ জন্যই বারবার তাকে সমর্থন দিতে হয়।
লেখকঃ সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ২৯ আগস্ট ২০১৭