‘আমার নাম জুঁই। এসএসসির সার্টিফিকেটে লেখা জুঁই আক্তার, বাবা মৃত আব্দুল জলিল। অবশ্য আব্দুল জলিলটা কে আমি আজও জানি না। কেননা আমার বাবা আব্দুল জলিলও হইতে পারে আবার হরিপদও হইতে পারে। সেইটা নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা নাই। আমার একমাত্র পরিচয় আমার জন্মদাত্রী মা ডলি আক্তার। দেশের সবচেয়ে বড় পতিতাপল্লীর একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে যার বাস।
হ্যাঁ, আমার মা একজন পতিতা। আপনারা ভদ্রভাষায় যৌনকর্মীও বলতে পারেন, আবার নাক সিটকিয়ে বেশ্যাও বলতে পারেন। তাতে অবশ্য তার প্রতিদিনের জীবনের তেমন কোনো ফারাক হয় নাই।
শুনছি আমার জন্ম ওইখানেই, দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীতে। যেখানে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে জ্বলে ওঠে লাল নীল বাতি, যেনো আঁধার নামতেই দিনের শুরু। শুরুতো বটেই। পুরুষ খদ্দেরে ভরে যেতে থাকে পুরো পাড়া। বড় হয়ে শুনছি ওটাকে নাকি নটিপাড়াও বলে। তা ওই নটিপাড়ায় ভদ্রলোকেরা আসে সন্ধ্যের পরেই। আসে, টাকা দেয়, শরীরের তৃপ্তি মেটায় তারপর চলে যায়। হয়তো আজ আছে পশ্চিমের ঘরে, কাল পুবের ঘরে। পার্থক্য শুধু শরীর বদলে।
আমার জন্মের পর মা আমাকে নানীর বাড়িতে পাঠায় দেয়। হয়তো চাইছিলো পড়াশোনা করে মানুষ হবো, চাকরি করবো, যদি বাবার একটা মিথ্যা পরিচয় দেওয়া যায়, তাহলে বিয়েও করবো। হয়তো মা চায় নাই শত শত পতিতার মতো আমিও ঘরে দিনে আট-দশটা কাষ্টমারের যাতায়াত শেষে শরীরের ব্যথায় কাতরাইতে কাতরাইতে নেশা করে ব্যথা কমাই।
হয়তো মা চায় নাই কিশোরী শরীরটা ট্যাবলেট খেয়ে ডাঁসা হয়ে উঠুক। হয়তো মা আরো অনেক কিছু চায় নাই। আমার যে একজন জীবিত মা আছে, সেটা আমি জানছি যখন আমার বয়স সাত কি আট। ঘরে একদিন একা ছিলাম, নানী বাজারে গেছিলো। পাশের বাড়ির সেলিম চাচা নানীকে খুঁজতে এসে দরজা বন্ধ করে আমাকে কোলে নিয়ে বিছানায় যায়। তারপর চিৎকার শুরু করলে একটা জামা মুখে পুরে দেয় আর বলতে থাকে- ‘চুপ কর নটি’।
এটুকুই মনে আছে। পরে নানী হাসপাতালে নিয়ে যায় অজ্ঞান অবস্থায়। জ্ঞান ফেরার পর নানীকে বারবার বলছিলাম- ‘সেলিম চাচা আমাকে ব্যথা দিছে, ওরে তুমি মারো নানী, ওরে তুমি মারো।‘ তখন বুঝিনি সেলিম চাচারা মাইর খাইতে এ দুনিয়ায় আসে না, মাইর দিতে আসে। সুস্থ হয়ে ফেরত আসার পর একদিন নানী আমাকে নিয়ে গেলো বাজার মতন এক জায়গায়। দেখি খুব সুন্দর পরীর মতো এক মহিলা মাথায় ঘোমটা দিয়া সেখানে অপেক্ষা করতেছে। আমাকে দেখার সাথে সাথে জড়ায়ে ধরে সে কী কান্না! আমি তখনো বুঝতে পারি নাই এইটা আমার মা। অনেক আদর করে চকলেট চিপস দিয়ে সেদিন আমাকে বিদায় দেয়, মাত্র পনেরকি বিশ মিনিট ছিলাম ওইখানে। বাসায় গিয়ে নানী জানায় ঐটা আমার মা ছিলো, আর আমার বাবা মারা গেছে। মা একটা জরুরি কাজ করে বলে আমাকে সাথে রাখতে পারে নাই, আর দেখা করতে পারবে না বলে এতোদিন তার পরিচয় দেয়া হয় নাই। ছোট মানুষ আমি, যা বুঝাইছে, তাই বুঝছি।
একমাস পর আবার তার সাথে দেখা হয়। সেদিন আমার সাথে কাপড়চোপড় গোছানো একটা ব্যাগ। আমাকে একটা স্কুলের মতো জায়গায় নিয়ে যায়। সেদিন আমাকে বলেছিলো- ‘আজ থেকে তুমি এইখানে থাকবা, পড়াশোনা করবা মন দিয়ে। আমি মাস গেলে দেখতে আসবো। এইখানে তোমার মতো আরও মেয়ে আছে। তাদের সাথে মিলেমিশে থাকবা, স্যার-ম্যাডামরা যা বলে শুনবা।‘ আমি ভয়ে ভয়ে অফিস ঘরের জানলা দিয়ে দশ হাত দূরের পাঁচিলঘেরা এলাকাটা দেখতে থাকি, আর ভয়ে আমার গা ছমছম করতে থাকে।
এখানে আসার আগের রাতে নানী বলছিলো- ‘তোর মা তোরে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিবে। ঐখানে গেলে তুই মানুষ হবি, শিক্ষিত হবি।‘ ওখানে যাওয়ার কয়েকদিন পর জানতে পারি, ওইটা একটা সেইফহোম ছিলো, আর ওখানে আমার মতো যারা ছিলো তারা সবাই পতিতার সন্তান ছিলো। তখন পতিতা কী, ঠিকমতো জানতাম না। বয়সে বড় মেয়েরা একদিন একটু আধটু বুঝাইতে শুরু করলো, আর আমার বারবার মনে পড়তে থাকে সেলিম চাচার কথা। শরীরের সাথে শরীরের সম্পর্ক কেমন ওইটাই যে আমার একমাত্র অভিজ্ঞতা! আমি হাঁটুতে মুখ লুকায়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। কেবলই মনে হইতে থাকে, মা প্রতিদিন ওইরকম কষ্ট সহ্য করে, ঠিক যেইরকম কষ্ট আমি সেইদিন পাইছিলাম। হোস্টেলের ম্যাডামরা এসে আমার কান্না থামায়। সেদিন আমি কাউকে বলতে পারিনি আমি কেনো কাঁদছি। কেনো যেনো মনে হইছিলো এ কথা বলা যায় না।
এরপর প্রায় দশবছর আমি ছিলাম ঐ সেইফহোমে। ওখানে আমি পড়াশোনা করছি, সেলাইয়ের ওপর একটা ভোকেশনাল ট্রেনিং নিছি। এসএসসির পর ট্রেনিংটা নেই। আমাদের সবাইকে ট্রেনিং দেয়া হইছিলো ভবিষ্যৎ চাকরির জন্য। ততদিনে আমি বুঝতে শিখছি পতিতা আসলে কী, পতিতা কাকে বলে, পতিতাদের কাছে কারা যায়, কেনো যায়। মা মাঝে মাঝে আসতো, দেখা করতাম। আমি তার মুখের দিকে তাকায়ে থাকতাম, সে হাতটা ধরে নানান কথা বলতো। কোথায় গেলে কিভাবে চলতে হবে, পরিচয় কিভাবে লুকাইতে হবে, অনেক পড়াশোনা করতে হবে, অনেক বড় চাকরি করতে হবে। আমি চুপচাপ শুনতাম।
একদিন মা এসে বললো- ‘তোর সেইদিনের ঘটনা শোনার পরই আমি তোকে এখানে ভর্তি করবো বলে সিদ্ধান্ত নেই।‘ সেইদিনের ঘটনা মানে সেলিম চাচার ঘটনা। আবারো আমার শরীর কেঁপে ওঠে। আমি মা’কে জড়ায় ধরে কাঁদতে থাকি। মাও আমার সাথে কাঁদতে থাকে, আর বলে- ‘এরকম কষ্ট আমি বাঁইচা থাকতে তোরে কোনদিন পাইতে দিব না।’
ছয় মাস ট্রেনিং শেষ করে ঢাকায় নারায়ণগঞ্জের একটা গার্মেন্টসে আমাদের কাজ দেয়া হয়। মাসখানেক কাজ করে বুঝলাম এখানে কাজ করলে পড়াশোনা করা হবে না। কী যে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হইত! ডিউটি শেষে ওভারটাইম করতে হইত। আমার সাথে যে কয়জন মেয়ে ওখানে কাজ করতে যায় সবাই কয়েকদিন পর চলে যায়, কেউ কেউ পালিয়ে যায়।
আমি মা’কে ফোন দেই, কান্নাকাটি করি, বারবার বলি আমি কাজ করবো না, পড়তে চাই। মা বোঝে, সেইফহোমে কথা বলে। এর মাঝে গার্মেন্টসের সুপারভাইজার জানতে পারে আমি এবং আরও যারা ছিলো তারা সবাই পতিতাপল্লীর সন্তান। পরে জানছি গার্মেন্টসের মালিক জানতো আমাদের পরিচয়। যেহেতু আমরা যেই সেইফহোমে ছিলাম সেখান থেকে আমাদের কাজের ব্যবস্থা করা হয়, সেহেতু একটু খোঁজ করার পর কথাটা আর গোপন থাকে না। এককান দুইকান করে পুরা ফ্যাক্টরি ছড়ায় যায়। ফলে শুরু হয় নানান কথাবার্তা। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেকে আমাকে নানান খারাপ প্রস্তাব দিতে থাকে। কেবলই মনের মধ্যে সেলিম চাচার ঘটনাটা ফিরে ফিরে আসতে থাকে।
একদিন ওভারটাইম শেষ করে ফেরার পথে ঐ ফ্যাক্টরির ভেতরেই কয়েকজন আমার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। চিৎকার চেঁচামেচি করে কোনমতে উদ্ধার পাই। দৌড়ে হোস্টেলে যাই, ব্যাগ গুছিয়ে ভোরের প্রথম বাসে উঠে চলে আসি সেইফহোমে। সেদিনও বলতে পারিনি কী ঘটছিলো। শুধু এটুকু বলছিলাম- ‘অনেক পরিশ্রমের কাজ,আমি করতে পারতেছি না। আমি পড়াশোনা শেষ করতে চাই।‘
আমার মা’কে জানানো হয়। মা আমার খরচ দিতেও রাজি হয়। সেইফহোমে আবার বসত গড়ি। মা আসে, চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে-‘ওইসব ফ্যাক্টরির কাজ করা লাগবো না তোর। তুই পড়াশোনা শেষ কর। বড় চাকরি করবি যেইখানে সম্মান আছে।‘ আমি চুপ করে থাকি। মা কিভাবে বুঝছিলো ফ্যাক্টরির কাজে সম্মান নাই? মা কি চোখ দেখেই বুঝে গেছিলো? মা কি সবসময় নিজেকে আয়নায় দেখতে দেখতে অভ্যস্ত? তাই আমার চোখে তাকাতেই বুঝে গেছিলো? মায়েরা কি সব বুঝে? মা’কে জড়ায়ে ধরে খুব কাঁদছিলাম। মা বলছিলো- ‘তোরে আমি অনেক শিক্ষিত লোকের কাছে বিয়ে দিব দেখিস। যে তোরে সম্মান, ভালোবাসা দিব। তুই বড় চাকরি করবি, সমাজে মাথা উঁচু করে চলবি। দেখিস।‘
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর হঠাত মা অসুস্থ হয়ে যায়। কোমরে ব্যথা, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলেও জোরে চলাচল করতে পারে না। ফলে মায়ের ব্যবসার পসার কমতে থাকে। আমি বুঝতে পারি আমার নিজের কিছু একটা করার সময় হইছে। মা আমাকে আর বেশিদিন খরচ দিতে পারবে না, আর সেইফহোমও আমাকে আঠারো বছর পর আর রাখবে না। পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পর দেখা গেলো খুব ভালো রেজাল্ট করছি। সেইফহোমের আপা নিজে একটা স্থানীয় এনজিওতে ফ্যাসিলিটেটরের পদে কাজ জুটায় দিলেন। বেতন মোটামুটি।
তখন আমার একটাই স্বপ্ন মা’কে কিভাবে ছুটায়ে আনবো ওখান থেকে। টাকা আয় করে খরচ করে যা থাকে জমাতে থাকি। নানীকে সাথে নিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকি। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি নানী আকুল নয়নে কাঁদতেছে। আমাকে দেখে জড়ায় ধরে বললো-‘জুঁইরে, তোর মা নাই রে’। আমার কাছে সেদিনের মাসের বেতন, আসতে আসতে ভাবতেছিলাম এখান থেকে হাজার তিনেক টাকা সরায় রাখলে জমবে বিশ হাজার টাকার কাছাকাছি। মা’কে আর বছর খানেকের মধ্যে ছাড়ায়ে আনবো। আমি কাঁদিনি সেইদিন। শুধু কানে বাজতেছিলো- ‘তোরে আমি অনেক শিক্ষিত লোকের কাছে বিয়ে দিব দেখিস। যে তোরে সম্মান, ভালোবাসা দিব। তুই বড় চাকরি করবি, সমাজে মাথা উঁচু করে চলবি। দেখিস।‘
——————————————————————–
এতোক্ষণ যা পড়লেন প্রথম থেকে আবার পড়েন। শেষ করে আবার, তারপর আবার। একটা মেয়ের আঠারো বছরের জীবনের গল্প পড়লেন আপনারা বারশো-তেরশো শব্দে। মেয়েটা এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, সাথে সেই চাকরি করছে। পড়াশোনা শেষ করে আরও ভালো একটা চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন যার চোখেমুখে খেলা করে। ইন্টার্ভিউয়ের ফাঁকে ফাঁকে শুধু দেখছিলাম রেকর্ডারটা ঠিকমতো অন আছে কি না!
এছাড়া তার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারিনি এক মুহূর্তের জন্য। এতো দীপ্ত বলিষ্ঠ এবং শীতল কন্ঠস্বর আমি খুব কম মানুষের শুনেছি। ছদ্মনামে জুঁই সেদিন দুইঘন্টা টানা বলে গিয়েছিলো তার জীবনের কথা। গল্পের শেষে হয়তো আমার কিছু বলা উচিৎ। কিন্তু আমি জুঁইয়ের বক্তব্য দিয়েই শেষ করি। উত্তরটা নিজেরা নিজেদের বুকের ভেতর খুঁজবেন আশা করি।
‘শোনেন, মাঝে মাঝে টিভি দেখি। কত টকশো হয়, কত বড় বড় মানুষ বক্তৃতা দেয়, দেশের কত কত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। মাঝে মাঝে অফিসে সময় পাইলে পেপারও পড়ি। কত ঘটনা, দেশের কত উন্নতি নিয়ে আলোচনা। জানেন, আমি কিন্তু ফেসবুকও ইউজ করি। কত মানুষ কত সুখ দুঃখ হাসি কান্নার কথা বলে। কই, কেউ তো আমাদের কথা বলে না। আমরা কেমন আছি, কই আছি! ঐ যে টকশোর শিক্ষিতরা, ওনারা তো একবারও বলে না আমাদের কথা! আমারে জিজ্ঞেস করতেছেন আমার মায়ের পেশার কথা বলতে আমার লজ্জা লাগতেছে কি না, খারাপ লাগতেছে কি না? না আপা, একদম খারাপ লাগতেছে না। এই পেশা টিকায় রাখছে এই সমাজ। সমাজের প্রয়োজন না থাকলে এই পেশা টিকে থাকতো বলেন? তাইলে আমার মায়ের শুধু দোষ হবে কেনো? আর আমার খারাপ লাগবে কেনো?
জানেন, আমরা একটা সরকারি চাকরি করতে পারবো না। কারণ আমাদের বাবার পরিচয় নাই। অথচ সরকার না চাইলে কি এইসব পতিতাপল্লী টিকে থাকতো? একটা কথা কি জানেন- এই দেশে গরীবের মেয়েকে বিয়ে করা যায়, প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে করে সমাজে সম্মানিত মানুষ হওয়া যায়, এসিডে ঝলসায়ে যাওয়া মেয়েকেও বিয়ে করা যায়। কিন্তু একজন যৌনকর্মীর পিতৃপরিচয়হীন মেয়েকে কি বিয়ে করা যায়?
যায় না আপা। যায় না কারণ এই জন্মটা অবৈধ, এদের জারজও বলে। কতো শিক্ষিত, কতো জ্ঞানীগুণী, কতো অধিকার নিয়ে কথা বলা মানুষ আছে চারপাশে। বলেন তো আপা, আছে আপনার কাছে এমন কোনো মানুষ, যে বুকে শক্তি নিয়ে বলবে- ‘আমি একজন পতিতার সন্তানকে বিয়ে করতে চাই।‘ কেউ করবে না আপা, কেউ না।‘
(এটি একটি সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ)
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, ০২ নভেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ